শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

রাশিয়ায় ইসলাম গ্রহণ করলেই বন্দীরা হয়ে যান ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী’

আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৫, ১২:৩২

রাশিয়ার কারাগারগুলোতে মুসলিম বন্দীদের জন্য কঠোর শর্ত ও নজরদারি আরও বেড়েছে। ধর্মান্তরিত হলেই সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হওয়া এবং কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে মধ্য এশিয়া থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীরা এই সংকটের মুখে পড়ছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। খবর আল জাজিরার। 

২০২৩ সালের নভেম্বরের তীব্র ঠান্ডায় সাইবেরিয়ার কারাগারে পাঠানো হয় ক্রিমীয় তাতার সম্প্রদায়ের নেতা নরিমান ঝেলইয়ালকে। কারাগারে তার খাবারের তালিকায় ছিল মূলত শূকরের মাংস, যা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। তাই তিনি কেবল রুটি ও জাউ খেয়ে দিন কাটিয়েছেন।  

তার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ লাইন উড়িয়ে দেওয়া ও বিস্ফোরক চোরাচালানের অভিযোগ আনা হয় এবং ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ইউক্রেনের দাবি, এটি মস্কোর সাজানো ঘটনা।  

পরে ঝেলইয়ালকে মিনুসিনস্ক শহরের কারাগারে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে কিছুটা উন্নত খাবার পেলেও কারাগারের পরিবেশ ছিল কঠোর।  

রাশিয়ার কারাগারগুলো প্রধানত দুই ধরনের –  ‘ব্ল্যাক প্রিজনস’, যেখানে মাফিয়া ও দুর্ধর্ষ অপরাধীরা কারাগারের নিয়ন্ত্রণ রাখে। এখানে সংঘর্ষ, মাদক চোরাচালান ও সহিংসতা নিত্যদিনের ঘটনা।  অন্যটিকে বলা হয় ‘রেড প্রিজনস’, যেখানে কারা তত্ত্বাবধায়কেরা বন্দীদের ওপর কঠোর নির্যাতন চালান। নির্জন কারাবাস, শারীরিক নির্যাতন, অপুষ্টিতে রাখা এবং ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।  

তবে গত দুই দশকে আরেকটি নতুন শ্রেণির বন্দী দেখা যাচ্ছে – মুসলিমরা।  

রাশিয়ার ১৪ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলিম, এবং এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। কারাগারগুলোতেও মুসলিম বন্দীর সংখ্যা প্রায় ৩১ হাজার।  

রাশিয়ার ফেডারেল কারা প্রশাসনের সাবেক বিশ্লেষক আনা কারেতনিকোভা বলেন, 'যদি কোনো বন্দী খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন, তবে তাকে স্বাগত জানানো হয়। কিন্তু কেউ ইসলাম গ্রহণ করলেই তাকে সন্দেহভাজন উগ্রপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।'  

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী বন্দীদের ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়ানোর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে এবং অনেক সময় তাদের শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।   

রাশিয়ায় কাজ করতে আসা মধ্য এশিয়ার অভিবাসী মুসলিমরা আরও বড় সংকটে রয়েছেন। তাদের অনেকেই রুশ ভাষা বা আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন না, ফলে সহজেই পুলিশের ফাঁদে পড়েন।  

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, অনেক অভিবাসীকে ভুয়া অভিযোগে ফাঁসিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছে, এমনকি জোরপূর্বক ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে।  

এক অভিবাসী আবদুল আজিজ জানান, তার ভাই আবদুল মুমিনকে মাদকের ভুয়া মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। পরে তাকে সাড়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে ইউরাল মাউন্টেইনসের কারাগারে পাঠানো হয়।  

রাশিয়ার কিছু কারাগারে নামাজ আদায়, রোজা রাখা এবং কোরআন পড়ার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে।  

- রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বন্দীদের খাবার খেতে ও বিছানা ছাড়তে দেওয়া হয় না, যা ফজর ও মাগরিবের নামাজে বাধা সৃষ্টি করে।  
- রমজানে রোজা রাখা কঠিন হয়ে যায়, কারণ ইফতার বা সেহরির জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা থাকে না।  
- কিছু কারাগারে কোরআন ও আরবি ভাষার বই নিষিদ্ধ, কেবল রুশ ভাষায় অনূদিত ধর্মীয় বই পাওয়া যায়।   

তবে কিছু কারাগারে মুসলিম বন্দীদের প্রতি তুলনামূলক নমনীয় আচরণ করা হয়। যেমন, মিনুসিনস্ক কারাগারে বন্দীরা নামাজ পড়তে এবং রমজানে নিজ কক্ষে খাবার খাওয়ার অনুমতি পান।  

ক্রিমীয় তাতার নেতা ঝেলইয়াল জানান, মুসলিম বন্দীরা সাধারণত অন্যদের মতো চোরাচালান বা অপরাধে জড়িত থাকেন না। কিন্তু তারপরও তাদের ওপর নজরদারি বেশি এবং শাস্তিও বেশি কঠোর।   

২০০০-এর দশক থেকে রাশিয়ার কারাগারে মুসলিম বন্দীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, বিশেষ করে চেচনিয়া যুদ্ধের পর। চেচেন বিদ্রোহীদের ‘উগ্রপন্থী’ আখ্যা দিয়ে রাশিয়া হাজার হাজার মুসলিমকে গ্রেপ্তার করেছে।  

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ইসলাম গ্রহণ করা মানেই এখন সন্দেহের তালিকায় ঢুকে যাওয়া। রাশিয়ার কারাগারগুলোতে মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে এবং তাদের প্রতি বৈষম্য বেড়েই চলেছে।

ইত্তেফাক/টিএইচ