বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

তীব্র গরমে বাড়ছে সর্দি-কাশি-জ্বর ও শ্বাসকষ্ট

  • রোদে অযথা বাইরে ঘোরাফেরা করা যাবে না—ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ বি এম আবদুল্লাহ
  • এ সময় হিট স্ট্রোক হতে পারে—জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৪১

চৈত্রের শেষে সূর্যের তেজ যেন প্রকৃতিকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাপপ্রবাহের ফলে হঠাত্ তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। প্রকৃতির এই পালাবদলের সময়ে দুর্বল মানুষগুলোর শরীরে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা নানা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ভোগেন। বিশেষ করে, শিশু ও বয়স্করা এর শিকার। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলছেন, প্রকৃতিতে তাপমাত্রার  পরিবর্তনের সময়ে—সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, সিওপিডি, টনসিলাইটিস, ফ্যারিঞ্জাইটিস, সাইনোসাইটিসে আক্রান্ত হয় মানুষ। দেশ জুড়ে হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর। তীব্র গরমের সময়কে মোকাবিলা করতে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, পরিবেশের তাপমাত্রার ওঠানামার কারণে পরিবেশে বাস করা কতগুলো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে আমরা দেখতে পাই ভাইরাসজনিত শিশুদের নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং বড়দের ডায়রিয়া বেড়ে যায়। গরমের সময় মানুষ পিপাসার্ত হয়ে সামনে যে পানিই পায় সেটাই পান করে। ফলে পানিবাহিত ও খাদ্যবাহিত রোগ ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি, জন্ডিস, টাইফয়েড এবং যত্রতত্র পানি পান করার জন্য পানিতে থাকা ময়লার কারণে ফুড পয়জনিং হয়। তারা বলছেন তীব্র গরম—ঘাম দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় ফুড পয়জনিং, পানিবাহিত রোগ, হিট স্ট্রোক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুর মতো ঘটনা দিয়ে। আর শিশুদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া—এটিও শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

ইমিরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ইত্তেফাককে বলেন, এই সময়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে, আর এই পরিবর্তন চিরন্তন। এই সময় গরম বেশি, গরমে মানুষ রাস্তাঘাটের পানি, শরবত, গুড়ের শরবত, আখের শরবতসহ বিভিন্ন শরবত খেয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে। এ সময় বক্ষব্যধির রোগ বেশি দেখা যায়, কমন কোল্ড, টনসিলাইটিস, ফ্যারিঞ্জাইটিস, সাইনোসাইটিস, অনেকের আবার নিউমোনিয়া হচ্ছে। যাদের আগে থেকে শ্বাসকষ্ট আছে, অ্যাজমা, হাঁপানি, সিওপিডি বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া বাইরের আজেবাজে খাবার খেয়ে ডায়রিয়াজনিত রোগ বেশি হচ্ছে, এটা আবার বাচ্চাদের বেশি হয়। এছাড়া এ সময় টাইফয়েড, প্যারা-টাইফয়েড, জন্ডিস 

হয়। এ সময় আবার ডেঙ্গুর পদধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। তাই নিজের ঘরবাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যাতে ডেঙ্গু মশা আক্রমণ করতে না পারে।     

প্রখ্যাত এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এসব সমস্যা প্রতিকারে—অযথা বাইরে ঘোরাফেরা না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, রোদে বেশি যাওয়া যাবে না। যারা শ্রমজীবী মানুষ, তারা মাথায় যেন একটা শেড দেয়, ছাতা ব্যবহার করে বা মাথায় যেন একটা কাপড় দেয়, আর বিশুদ্ধ পানি পান করবে। রাস্তাঘাটের খোলামেলা জায়গার পানি পান করবে না। প্রয়োজনে নিজের ঘর থেকে ফুটানো বিশুদ্ধ পানি সঙ্গে নিয়ে বের হবে এবং খাবে। নিজের ঘরে তৈরি খাবারও দীর্ঘক্ষণ বাইরে রাখলে নষ্ট হয়ে যায়, সে কারণে খাবারটা যত্ন করে ফ্রিজে তুলে রাখতে হবে। হয়তো নিজের ঘরে তৈরি খাবার খেয়েও মানুষ অসুস্থ হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, তীব্র গরমে মানুষ বাইরে যখন যায়, তখন ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়; ফলে শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয় এবং লবণের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে পিপাসা বেশি পায়, মাথা ঘোড়ে শরীর অবসন্ন লাগে, রক্তচাপ কমে যায় এবং তীব্র গরমে ‘হিট স্ট্রোক’ নামে একটি সমস্যা হয়, মানুষ এ সময় জ্ঞান হারাতে পারে। এ সময় রক্তের চাপ কমে যায়, নাড়ির গতি বেড়ে যায়, প্রথম দিকে অসংলগ্ন কথা বা আবোলতাবোল কথা বলতে থাকে, এবং একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এটি হচ্ছে গরমের প্রাথমিক প্রভাব।

আর একটা হচ্ছে গরমের কারণে মানুষ অস্বস্তি বোধ করে, কর্ম-উদ্দীপনা কমে যায় বা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, একধরনের অবসাদ তৈরি হয়। এর বাইরে হঠাত্ গরম থেকে ঘরে এসে ঠান্ডা এয়ারকান্ডিশন রুমে বা ঠান্ডা পানি খেলে, শরীরের তাপমাত্রার হঠাত্ পরির্তন হয়—এই পরিবর্তনের কারণে শরীরের ভেতরে বাস করা সুবিধাবাদী যে রোগজীবাণুগুলো রয়েছে তা সক্রিয় হয়ে ওঠে, যে কারণে—গলাব্যথা, ফ্যারিনঞ্জাইটিস, জ্বর কাশি হয়।

প্রতিকারে এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রতিদিন সকালে একটা সতর্কতা সংকেত জারি করা দরকার যে, ‘আজ তাপমাত্রা বেশি থাকবে’, অতএব যারা সংবেদনশীল মানুষ—গর্ভবতী নারী, বয়স্কা মানুষ, নারী ও শিশু—তারা যেন এ সময় তীব্র রোদে বের না হয়। বের হলেও সুতির ঢিলেঢালা জামাকাপড় পরবে। গরমের কারণে যদি কেউ অবসন্ন হয়ে বসে পড়েছে বা শুইয়ে পড়েছে, তাহলে তাকে দ্রুত ছায়াযুক্ত জায়গায় নিতে হবে, তার শরীরে টাইট জামাকাপড় থাকলে, তা ঢিলা করে দিতে হবে, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। শরীরে পানির ছিটা দিতে হবে এবং ধীরে ধীরে অল্প অল্প পানি পান করাতে হবে। আর কেউ যদি পড়ে গিয়ে অসংলগ্ন কথা বলতে থাকে বা ঢলে পড়ে যায়, তাহলে তাকে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, যারা দীর্ঘদিন রোগে ভুগছে, তাদের শরীরে তো রোগপ্রতিরোধক্ষমতা এমনিতেই কম থাকে, তারা যেনো তীব্র রোদে বের না হয়।

ইত্তেফাক/এনএন