বাঁশির গ্রাম শ্রীমদ্দি। হোমনা উপজেলা সদর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। সারা বছরই এখানকার কারিগরেরা বাঁশি তৈরি করেন। তবে তাদের বিক্রির প্রধান লক্ষ্য থাকে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে। বৈশাখ এলেই শ্রীমদ্দি গ্রামের কারুশিল্পীদের মুখে হাসি ফুটে।
বাঁশির কারিগরেরা জানান, মহামারি করোনা এবং এরপর নববর্ষে রোজা থাকায় গত কয়েক মৌসুমে তাদের সময় ভালো যায়নি। এতে অভাব অনটনে থেকে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে গেছেন। তবে এবার চারদিক থেকে ভালো সারা পাচ্ছেন বলে জানান কারিগরেরা।
শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশের বাঁশির সুখ্যাতি দেশ পেরিয়ে বিদেশেও রয়েছে। সারা দেশে শ্রীমদ্দি গ্রামটি বাঁশির গ্রাম হিসেবেই পরিচিত।
বাঁশির প্রবীণ কারিগর আবুল কাশেম জানান, শ্রীমদ্দি গ্রাম থেকে ১৬ ধরনের বাঁশি সারা দেশে যায়। করোনাকালীন লোকসান পুষিয়ে নিতে কারিগরেরা আবারও বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত হয়েছেন। আশা করছি, দীর্ঘদিন পর হলেও কিছুটা গতি আসবে ব্যবসায়।
শনিবার শ্রীমদ্দি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ত বাঁশির কারিগরেরা। প্রতিটি বাড়িতেই নারী-পুরুষ একত্রে কাজ করছেন। কেউ কয়লার আগুনে লোহা গরম করছেন। কেউ আবার লোহা দিয়ে বাঁশি ছিদ্র করছেন। কেউ বাঁশিতে তুলির আঁচড় দিচ্ছেন। আবার কেউ বা গুণে গুণে বস্তায় ভরছেন।
২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ গ্রামে বাঁশি তৈরি হচ্ছে বলে জানান, গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মোল্লা। তিনি আরও বলেন, একসময় এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষেরই পেশা ছিল বাঁশের বাঁশি তৈরি করা। বর্তমানে ৩০টি পরিবার এ শিল্পটিকে ধরে রেখেছেন। চট্টগ্রামের ফটিক ছড়ি ও ভারতীয় সীমান্ত এলাকা থেকে তারা সরু মুলি বাঁশ কিনে আনেন। প্রথমে এ বাঁশ রোদে শুকানো হয়।
এরপর বিভিন্ন ধরনের বাঁশির উপযোগী বাঁশগুলো বাছাই করে বেছে মসৃণ করে মাপ অনুসারে কাটতে হয়। মোহন বাঁশি, নাগিনী বাঁশি, মুখ বাঁশি, আড় বাঁশিসহ নানা ধরনের বাঁশি তৈরি করেন কারিগরেরা। এসব বাঁশির দাম ডিজাইন ও গুণাগুণ ভেদে ১০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
বাঁশির কারিগর যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেন, শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি দেশের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে জাপান, সিঙ্গাপুর, ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প রপ্তানিতে সহায়তা করে।
বাঁশ আনা নেওয়ার খরচ এবং কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো লাভ হচ্ছে না বলে জানান কারিগরেরা। গ্রামের অশীতিপর বাঁশির কারিগর সিরাজুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আমরা অনেক কষ্ট করে এ শিল্পটিকে ধরে রেখেছি। কিন্তু এর জন্য কাঁচামাল আনা ও বাঁশি তৈরি করে বিক্রির জন্য বিভিন্ন মেলায় নিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের নানাভাবে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয়।
বাঁশির কারিগর যামিনী মোহন বিশ্বাস বলেন, এ গ্রামের বাঁশি শিল্পটি দেশের জন্য একটা ঐতিহ্য। সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে না এলে শিল্পটি বিলীন হয়ে যাবে।
গ্রামের বাসিন্দা হোমনা থানা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো. কামাল হোসেন জানান, যুগ যুগ ধরে শ্রীমদ্দি গ্রামের বাসিন্দারা বাঁশি তৈরি করে আসছেন। আর্থিক সহায়তাসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হলে গরিব কারুশিল্পীরা উপকৃত হবেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষেমালিকা চাকমা বলেন, শ্রীমদ্দি গ্রামের শত বছরের ঐতিহ্য এ বাঁশি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রশাসনের পক্ষে থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।