আজ ১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ-বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। এক অনন্য প্রাণোচ্ছলতা ও আবেগঘন আবহে প্রতি বৎসর এই দিনটি আমাদের হৃদয়ে লইয়া আসে নূতনের প্রতিশ্রুতি, অতীতের গ্লানিমোচনের প্রত্যয়, আর আগামী দিনগুলির জন্য এক আশাবাদী প্রত্যাশা। বাংলার অপূর্ব মাটিগন্ধমাখা প্রাণের এই বৈশাখ যেন প্রতি বৎসরই আমাদের ডাকিয়া বলে-'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো!'
বাংলা নববর্ষ শুরু হয় এমন একসময়, যখন বসন্তের দহনকাল পেরিয়া গ্রীষ্মের উদারতা প্রকৃতিকে ভরিয়া তোলে বিচিত্র রসাল ফলসম্ভারে। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি ফলের মুকুল সবুজ কাঁচা হইতে ধীরে ধীরে পরিণত হইতে শুরু করে। পহেলা বৈশাখ যেন প্রকৃতির এই রূ পান্তরের প্রতীক-একটি রূপান্তর, যাহা কেবল ঋতুর নহে, বরং আমাদের মনোজগৎ, আমাদের সময় ও সমাজেরও। বৈশাখের অর্থই যেন নূতনকে বরণ করিয়া লওয়া, পুরাতন ক্ষত মুছিয়া নূতন সম্ভাবনার পথে পা বাড়ানো। তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চারণ করেন: 'মুছে যাক গ্লানি, মুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।' এই আহ্বান কেবল ঋতু পরিবর্তনের নহে, ইহা এক আত্মিক শুদ্ধির আহ্বান, এক সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের সংকেত। আর তাই 'ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ!' কবিতায় কবির সেই রুদ্র-উদ্দীপ্ত আহ্বান যেন আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বিশ্ব এখন অস্থিরতার ভিতর দিয়া যাইতেছে। যুদ্ধ, জলবায়ুসংকট, বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতা আর সামাজিক বিভাজন আমাদের ঘিরিয়া ধরিয়াছে। এমন সময়ে বাংলা নববর্ষ আমাদের নতুন করিয়া ভাবিতে শেখায়-আমাদের মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন। কবি নজরুলের প্রলয়োল্লাসের ঝড় বহিতেছে বিশ্বব্যাপী। ইহার ভিতরেই কবি বলিয়াছেন- 'তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখির ঝড়।'
বাংলা নববর্ষের এই সময়টিতে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ উৎসব উদ্যাপিত হইয়া থাকে। এই উৎসবে রহিয়াছে ইরানের 'নওরোজ'-এর প্রভাব। মোগলরাই ইরানি ঐতিহ্যের সূত্রে ভারতে নববর্ষ চালু করে। ইরানের এই নওরোজ উৎসবের প্রভাব মধ্য এশিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলে লক্ষ করা যায়। কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলেও নববর্ষকে নওরোজ নামে অভিহিত করা হয়। তাহারা উৎসবটি উদযাপন করে ২২ মার্চ। মেঘনাথ সাহা ভারতের যে পঞ্জিকা সংস্কার করেন, তাহাতে ২২ মার্চকে নূতন বৎসরের ভিত্তি ধরিয়া ঐ তারিখের অনুষঙ্গী চৈত্র মাসকেই শকাব্দ পঞ্জিকার নববর্ষ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার বালি ও জাভা অঞ্চলের পঞ্জিকায় এই শকাব্দের অনুসরণে ২৬ মার্চ উদ্যাপন করা হয় নববর্ষ। প্রশ্ন উঠিতে পারে-পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষের এক দিনের হেরফের কেন হয়? বাংলাদেশে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে মেঘনাথ সাহার বৈজ্ঞানিক সংস্কার পদ্ধতি অনুসরণ করিয়াই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা সালের সংস্কার করেন। ইহার পরে আরো পরিপূর্ণ সংস্কারের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমি একটি টাস্কফোর্স গঠন করিয়া ১৪ এপ্রিলকেই বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন বা পহেলা বৈশাখ হিসাবে গ্রহণ করে। ভারতবর্ষ ছাড়াও থাইল্যান্ডের নববর্ষ 'সংক্রান' উদ্যাপিত হয় এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে। সার্বিকভাবে মার্চ ও এপ্রিলের মধ্যে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ উদ্যাপিত হইতে দেখা যায়। আমরা যে বৃহৎ এক মহাসাগরের স্রোতের অংশ, বাংলার নববর্ষ তাহারও ইঙ্গিত দেয়। আবহমানকালের এত বৎসরের এই সাল এখন মিশিয়া গিয়াছে বাঙালির জাতিসত্তায়।
বস্তুত, বাংলা নববর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা এক বৃহত্তর ধারার অংশ। ইহা এই বার্তা দেয় যে, আমরা আলাদা কেহ নহি। ইহা বর্তমানে প্রাত্যহিক জীবনে কাজে লাগুক বা না লাগুক, ইহা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আর এই ঐতিহ্যের মধ্যে আমাদের নিজেদের চিনিতে পারিব। আর নিজেকে চিনার মতো নিজেদের চিনাটাও জরুরি। নববর্ষ সেই চিনার কাজটি করে।
সময় এখন সৌহার্দের, ভ্রাতৃত্বের। সকলের শুভ হউক। শুভ নববর্ষ।