১৪৫ এবং ১২৫। বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে উভয় দিক থেকে দ্বিতীয় পরাশক্তি চীনের পণ্যে। আর বেইজিং ওয়াশিংটনের পণ্যে শুল্ক চাপিয়েছে ১২৫ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে কোনটিই কম নয়। এই সংখ্যাই আবার বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিশাল বোঝা এবং ভয়াবহ চীনে আমেরিকার পণ্যের আমদানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমেরিকার বাজারেও এই নতুন অন্ধনীতির প্রভাব পড়ছে। শেয়ারের লাগাতার দরপতনে হতাশ বিনিয়োগকারীরা তবে কোনো পক্ষই আগে সমঝোতার প্রস্তাব দিতে আপাতত বুজি নয়। দুই দেশই এর সমাধানের জন্য একে অপরকে এগিয়ে মাসার কথা বলছে। যদিও ভেতরে ভেতরে শুষ্ক নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। কেউ কেউ একে বাণিজ্যযুদ্ধ বলছেন, আবার কেউ বলছেন, এটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধা পেতে দরকষাকষি করতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন লড়াইয়ে নেমেছেন।
বাণিজ্য যুদ্ধের সুবিধা আছে!
বাণিজ্য যুদ্ধ এই প্রথম নয়, উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন-চীন, ১৯৩০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র-চীন ও অন্যান্য দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ শেষে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধের অসুবিধার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এর সুবিধাও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই যুদ্ধ প্রতিযোগিতা বাড়ায়, দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ে। ফলে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ নিজস্ব পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ানোই এর মূল লক্ষ্য।
ট্রাম্প আসলে কী চান?
ব্যবসায়ী থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মুনাফা কীভাবে অর্জন করতে হয় তা ভালো করেই জানেন। তাকে নিয়ে এমন মত অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের। তিনি ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক ঝুঁকিও। নিয়ে ফেলেন। এই যেমন বাড়তি শুল্কারোপের নীতি। তিনি জানেন যে, এর ফলে শেয়ার কজার এবং বিশ্ব বাণিজ্যে ভয়ংকর প্রভাব ফেলবে। কিন্তু তারপরও তিনি সেই কাজটি করেন। এ বিষয়ে গত নভেম্বরেই সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা বিল ব্রেইনশ বলেছিলেন, ট্রাম্পের চিরাচরিত কৌশল হচ্ছে-'আগে হুমকি, পরে আলোচনা'। আমি নিশ্চিত, চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ করা হবে। আইনি ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোর বিবেচনায় এটা বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর হবে বলে মনে করেন উইলিয়াম রেইনস। চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর শুল্কারোপের কথা নির্বাচনি প্রচারণায়ই অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রথম মেয়াদেও ট্রাম্প চীনের পণ্যে শুল্ক বাড়িয়েছিলেন। ট্রাম্প মূলত দেশের স্বার্থে অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে কর ও শুদ্ধকেই ব্যবহার করেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শীর্ষ অর্থনেতিক উপদেষ্টা স্টিফেন মিরান সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন শৃঙ্খল গড়ে তুলতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউজ নিশ্চিত করে যে, অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি দূর করা এবং দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোই মূল লক্ষন। আর লক্ষ্য পূরণের মূল অস্ত্র শুল্কারোপ। বিল রেইনসের মতে, ট্রাম্প গত ৪০ বছর ধরে বিশ্বাস করে আসছেন যে, বিশ্ব বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রতারণার শিকার হয়ে আসছে। তিনি বিশ্ব বাণিজকে ১৯৪৪ সালের মতো পুনর্গঠন করতে চান। তিনি সবাইকে সমঝোতার টেবিলে আনতে চান। ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে এক বৈঠকে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল।
ডলার পুরো বিশ্বের আর্থিক লেনদেনের মূল হাতিয়ার। এতে যুক্তরাষ্ট্র নানা সুবিধা ভোগ করে থাকে। এমনকি চাইলেই দেশটি যে কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে এবং এঐ দেশের জমাকৃত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে। কারণ ডলার আন্তজাতিক রিজার্ভের মূল মন্ত্র। কিন্তু মিরান বলছেন, ডলারের একটা বিশেষ মর্যাদা আছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি এর ফলে আমেরিকা বেশি মূলো পণ্য আমদানি করে এবং মার্কিন পণ্যের প্রতিযোগিতার হার কমিয়ে দেয়। স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ জেনিফার বার্নসসহ পর্যবেক্ষকরা বলেন, মিরানের নীতিই ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক শুল্কনীতির প্রাথমিক প্রভাবকের ভূমিকা পালনকারী। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন মূলত দরকষাকষিতে নিজেদের হাতকে শক্তিশালী করতে চায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর মাধ্যমে মার্কিন অর্থনীতিকে রক্ষা করতে চায়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, ৯০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রশাসনকে ৯০ থেকে ১৫০টি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে।
পিছু হটছে না চীন
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধের জেরে নাভিশ্বাস উঠেছে গোটা বিশ্বের। বিশ্ব শেয়ার বাজারে দরপত্রন চলছে কিন্তু কেউই পিছু হটছে না। ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, সমঝোতা করতে হলে চীনকেই এগিয়ে আসতে হবে। এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন যে, চীনকে মোকাবিলায় প্রয়োজনে গোপন অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। কিন্তু এরপরও চীন পিছু হটছে না। স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠছে, কী করে এতটা আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছে চীন। কোন বলে বলীয়ান জিনপিং প্রশাসন? চীনের নেতারা বলবেন, তারা কোনো ধমকের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। চীন এটাও বলেছে, ওয়াশিংটনের শুল্কের মুখে পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় তাদের অনেক বেশি কিছু করার। ক্ষমতা রয়েছে। শুল্ক যুদ্ধ শুরুর আগে চীনের বিপুল পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে চীনের। আয় দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ২ শতাংশ। চীনা প্রশাসন জানিয়েছে, শুল্কারোপ কেবলই সংখ্যার খেলায় পরিণত হবে। চীনা সরকার জানিয়েছে, এর ফলে মার্কিন রপ্তানিকারীরাও গভীর সমস্যায় পড়বেন সোজা কথায় চীন পরিষ্কার করে দিয়েছে, তারা আত্মসমর্পণ করবে না ট্রাম্পের কাছে। চীন ইতিমধ্যে কুটনৈতিক কাজও শুরু করেছে। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তার প্রতিবেশীসহ মিত্র দেশগুলোকে পাশে আনতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিদেশ সফরে যাচ্ছেন।
এদিকে চীনা মন্ত্রীরা বৈঠক করছেন দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব এমনকি ভারতের সঙ্গেও। পাশাপাশি এড শোনা যাচ্ছে, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে চীনা পাড়ির ওপর থেকে ইউরোপীয় শুল্ক প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ট্রাম্পের বন্ধের কারণে বিপাকে পড়েছে বৈদ্যুতিক পন্য প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো। বিশ্বের ম্যানুফেকচারিং হাব হিসেবে পরিচিত চীন। অ্যাপেলসহ বহু মার্কিন সংস্থা এখানেই তৈরি করে মোবাইলসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক পণ্য। মার্কিন সিদ্ধান্তের জেরে বিরাট সমসরয় পড়েছে এই সংস্থাগুলো। এমন পরিস্থিতির মাঝেই ট্রাম্প সরকারের। তরফে ঘোষণা করা হয়েছে যে, বৈদ্যুতিক পণ্যের ওপর কোনোরকম পারস্পরিক শুল্ক চাপানো হবে না।