বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

সাংবাদিকতার উত্থান ও ক্রমবিকাশ: সময়ের স্রোতে নিরবচ্ছিন্ন পথচলা

আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩:৩২

সংবাদপত্রের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, আদিযুগ থেকেই সংবাদ প্রচার করা হতো শিলালিপি বা পাথরে খোদাই করে লিখে। সময়ের পরিক্রমায় আজ সংবাদপত্র সেই শিলালিপি থেকে কাগজ হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে। একদিকে সংবাদপত্রের মাধ্যমে নিজেদের মতাদর্শ প্রচারণা ও স্বার্থ হাসিল করার ঘটনাও যেমন আছে, পক্ষান্তরে সংবাদমাধ্যম হয়ে ওঠেছে সমাজের দর্পণ ও রাজনৈতিক হাতিয়ার থেকে হয়ে উঠেছে গণমানুষের কণ্ঠস্বর। 

বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল উপনিবেশিক শাসনের ছায়ায়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা পেরিয়েছে বহু সময়, সম্মুখীন হয়েছে নানান সামাজিক ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের  আর নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে- তা  এসে দাঁড়িয়েছে আজকের অবস্থানে। 

উপনিবেশিক শাসনের গণ্ডিতে বাংলার সাংবাদিকতা      
ভারতে মুদ্রণযন্ত্রের মাধ্যমে সংবাদপত্রের গোড়াপত্তন হয় ইংরেজদের হাত ধরে। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ভারতবর্ষের প্রথম পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’। কিন্তু একচেটিয়া ব্যবসার কথা, দুর্নীতির কথা তুলে ধরায় পত্রিকাটি দুই বছরের মধ্যে বন্ধ করে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরপর ইংরেজি ভাষায় আরও কিছু পত্রিকা চালু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: দ্য ইন্ডিয়া গেজেট  ও কলকাতা গেজেট। যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে লিখেছিল। 

তবে বাংলা ভাষার প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’ ও সাময়িক পত্রিকা ‘দিগদর্শন’ প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালে। এর সম্পাদক জন ক্লার্ক হলেও বাঙালি পণ্ডিতরা এর কলকাঠি নাড়তেন। কিন্তু ‘সমাচার দর্পণ’  পত্রিকাটির সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহার, তথ্যবহুল উপস্থাপন ও স্বচ্ছতার কারণে পত্রিকাটি অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ১৮১৯ সালে রাজ রাম মোহন রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সংবাদ কৌমুদী’। এ পত্রিকায় তিনি তুলে ধরেন তৎকালীন সমাজের সতীদাহপ্রথাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কুসংস্কার। 

বাংলায় দৈনিক পত্রিকার যাত্রা শুরু হয় ১৮৩৯ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে সংবাদপত্রের জগতে তুমুল আলোড়ন ফেলে। ইংরেজদের হাতে ধরে যেমন ভারতবর্ষে পত্রিকার বিকাশ শুরু হয়, তেমনি ইংরেজরাই এই সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। তারা বিভিন্ন সময়ে সেন্সরশিপ অভ প্রেস, লাইসেন্সিং রেগুলেশন আ্যক্টসহ বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে। ১৮৪৭ সালে পূর্ব বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ’ প্রকাশিত হয় রংপুর থেকে। উল্লেখিত এটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। ১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় গণজারনের সময় এ অঞ্চলে (বাংলাদেশে) সংবাদপত্র শিল্প বিকাশের ভিত্তি প্রশস্ত হয়।

পাকিস্তান আমল (১৯৪৭-১৯৭১): নিপীড়ন ও প্রতিরোধে সাংবাদিকতা     
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর অশান্ত-অনিশ্চিত পরিবেশের কারণে এই অঞ্চলের সংবাদপত্র শিল্প যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। একের পর এক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো পুরনো সংবাদপত্রগুলিকে। বাংলা পিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে সংবাদপত্রের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ২৫৯ থেকে ১৬০।  ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলায় প্রথম দৈনিক পয়গাম (দৈনিক স্বদেশ) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকাটি ঢাকা থেকে কলকাতা স্থানান্তরিত হয়ে প্রকাশনা শুরু করে। যথাক্রমে দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকাও ১৯৫১ ও ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। এগুলো এখনও সংবাদপত্র জগতে শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে আছে।  

মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদ শিল্পে আরও বিপর্যয় নেমে আসে পূর্ব পাকিস্তানে। অনেকগুলো পত্রিকা এসময় বন্ধ হয়ে যায়। আবার বেশ কয়েকটি পত্রিকা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তবে বেশ কয়েকটি পত্রিকা পূর্ব পাকিস্তানের কিছু জায়গা ও ভারত থেকে প্রকাশিত হতো। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পত্রিকা হল: জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, সোনার বাংলা ও বাংলার বাণী। স্বাধীনতা অর্জনে ও মানুষের মনোবল বাড়াতে এসব পত্রিকার অবদান ছিলও অনস্বীকার্য। 

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টকে বিজয়ী রাখতে, আইয়ুব খান থেকে শুরু করে ইয়াহিয়া খান পর্যন্ত সকল সামরিক শাসনের বিরোধিতা, ১৯৬৬ সালে ৬ দফার পক্ষে অবস্থান, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জনগণকে একত্রিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দৈনিক ইত্তেফাক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইত্তেফাক সরকারের নির্দেশ মেনে সংবাদ প্রকাশ করতে বাধ্য হলেও সতর্কতার সাথে সত্য তথ্য উপস্থাপন করেছিলো। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলার ওপর কোন কিছু চাপাইয়া দেওয়ার চেষ্টা বরদাশত করা হইবে না’। এই রাতেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কামানের গোলায় দৈনিক ইত্তেফাকের, সংবাদ ও দ্য পিপল পত্রিকার তিনটি অফিস পুড়ে ফেলে। 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় (১৯৭১-১৯৯০): রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও গণমাধ্যমের সংগ্রাম 
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মুহূর্তে বাংলাদেশের পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১০টি। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলা প্রকাশনী থেকে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বিচিত্রা প্রকাশনা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন জারির মাধ্যমে সরকারকে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এতে ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন থেকে সরকারিভাবে প্রকাশিত চারটি পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস ব্যতীত সবগুলো পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে ১৯৭৫ সালের পরে পুরানো পত্রিকাগুলো আবার পুনরায় চালু করা হয়।

সামরিক শাসন ও সাংবাদিকতার সংকট
১৯৮২ -১৯৮৯ পর্যন্ত সংবাদপত্র ছিল স্বৈরশাসনের নিয়ন্ত্রণে। এ সময়ে সরকারের মালিকানাধীন এক মাত্র পত্রিকা ছিল ‘দৈনিক বাংলা’। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করায় এ সময় ৫০টি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। তবে আশির দশকের শেষের দিকে স্বৈরচারী শাসনের প্রতিবাদে মূলধারার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী সাংবাদিকতার একটা বিশেষ ধারা চালু হয়। এসময় দেশবন্ধু, খবরের কাগজ, পূর্বাভাস- কার্টুন প্রচ্ছদ সম্বলিত এসব কাগজ সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে। এ কারণে অনেক বাধা বিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছে এই পত্রিকাগুলোকে। তবে এসব পত্রিকাগুলো এরশাদ সরকারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। 

গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সংবাদপত্রের বিকাশ
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর নতুন এক অবয়ব নিয়ে ‘আজকের কাগজ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকা। এরপর ১৯৯৮ সালে ‘দৈনিক ভোরের কাগজ ভেঙ্গে ‘প্রথম আলো’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৯ সালে বাজারে আসে যুগান্তর।  এরপর একে একে সমকাল, আমার পত্রিকা, নয়া দিগন্তসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকা। ৯০ দশকে প্রকাশনা শিল্পে কম্পিউটার প্রযুক্তি সংযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে লাগে আধুনিকতার ছোঁয়া। ১৯৯৫ সাল থেকে রঙিন ছবি মুদ্রণ সংযোজিত নতুন পত্রিকা চালু হয়।

ডিজিটাল যুগের সাংবাদিকতা
১৯৯৬ সালের মাঝের দিকে বাংলাদেশ যখন ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখন এক নবদিগন্তের সূচনা হয় পত্রিকা শিল্পে। এ সময় ঢাকার দু’একটি দৈনিক পত্রিকা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শুরু করে। ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে  হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা তাদের ওয়েবসাইট সংস্করণের প্রচলন ঘটায়। ১৯৯৯ সাল থেকে ব্যাপকহারে সংবাদপত্রগুলো তাদের ওয়েবসাইট সংস্করণ চালু করে। ২০০৬ সালে প্রথম আলো এবং দৈনিক যুগান্তর অনলাইন সংস্করণ চালু করে। এর পাশাপাশি বিডিনিউজ ২৪.কম ২০০৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১০ সালের পর থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারের ফলে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের আদলে দেশীয় অনলাইন পত্রিকা গড়ে ওঠে। নিউজ পোর্টালগুলোর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। 

ইত্তেফাক/কেএইচ/এএস

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন