রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

অধিকার বনাম আবেগ: বাংলাদেশের পারিবারিক আইনে বৈষম্য ও বাস্তবতা

আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৬

সম্প্রতি নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন একটি সময়োপযোগী ও আলোচিত প্রস্তাব দিয়েছে - সব ধর্মের নারীদের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, যার আওতায় বিয়ে, তালাক, ভরণপোষণ ও উত্তরাধিকারের মতো মৌলিক অধিকার সমানভাবে নিশ্চিত করা হবে। প্রস্তাবটি উত্থাপনের পরপরই সমাজের একটি অংশ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, বিশেষ করে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষ থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে - এ দেশে আইন সংস্কারের প্রয়াস নিলেই কেন পারিবারিক ইস্যুগুলোতে ধর্মের প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে, অথচ অন্যান্য ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বহু আইন আমরা অনেক বছর ধরেই মেনে চলছি। এই দ্বৈতমানসিকতা বোঝার জন্য আমাদের আইনি কাঠামোর গভীরে গিয়ে দেখার দরকার রয়েছে - কোথায় কোথায় রাষ্ট্রীয় আইন ধর্মীয় আইনকে ছাড়িয়ে গেছে, আর কোথায় কোথায় ধর্মীয় আইনকে অপরিবর্তনীয় ধরে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হবে এবং সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালনের অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, পারিবারিক আইন - বিশেষ করে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণের মতো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় নিয়মকানুনই বলবৎ থাকে। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে আলাদা পারিবারিক আইন। এই আইনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। যেমন: মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে মেয়ের অংশ ছেলের চেয়ে অর্ধেক, হিন্দু নারীরা বাবার সম্পত্তিতে অধিকার পান না; আবার খ্রিস্টান নারীদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদ আইনি প্রক্রিয়ায় কঠিন ও দীর্ঘ। এই বৈষম্য মূলত ধর্মীয় ব্যাখ্যার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে, যদিও এদের বেশিরভাগই প্রাচীন ও বর্তমান সামাজিক বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অনেকে বলার চেষ্টা করেন মুসলিম নারীরা স্বামীর কাছ থেকে সম্পদ পেয়ে থাকেন তাই বাবার সম্পত্তি থেকে কম পাবার বিধান যৌক্তিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো একজন মুসলিম নারী তার স্বামী মারা গেলে স্বামীর সম্পদের আট ভাগের এক ভাগের মালিক হন, অন্যদিকে স্ত্রী মারা গেলে স্বামী তার রেখে যাওয়া সম্পদের চার ভাগের এক ভাগ পান। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও মুসলিম পুরুষরা নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি লাভ করেন। 

সকল ধর্মের প্রতি সম্মান রেখে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে - রাষ্ট্র যদি পারিবারিক আইনে ধর্মের বিধান ধরে রাখে, তাহলে কেন অন্যান্য ক্ষেত্রে সেই বিধান মানা হয় না? বাংলাদেশে এমন অনেক প্রচলিত আইন রয়েছে যেগুলো ধর্মীয় বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ, অনেক ধর্মে চুরির শাস্তি হিসেবে শরীরের অঙ্গ কর্তনের বিধান রয়েছে, কিংবা ব্যভিচারের জন্য পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার মতো কঠোর শাস্তির উল্লেখ আছে। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে চুরির শাস্তি জেল বা জরিমানা, কোনো শারীরিক শাস্তি নেই। ব্যভিচার এখন “সামাজিক অপরাধ” হিসেবে থাকলেও এর আইনি কাঠামো অনেকটাই সীমিত। বাস্তবতা হলো যখন ধর্মীয় আইন রাষ্ট্রীয় আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হয় এবং তা সমাজের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর অনুকূল হয়, তখন সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় না। কিন্তু যখন তা নারীর অধিকারের পক্ষে যায়, তখন ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।

ধর্মীয় আবেগকে অনেক সময় ব্যবহৃত হতে দেখা যায় - আইন সংস্কার রোধ করার একটি হাতিয়ার হিসেবে। বিশেষ করে পারিবারিক আইনে এটি বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ, এই আইনের মাধ্যমেই পরিবারে নিয়ন্ত্রণের কাঠামো নির্ধারিত হয়। যেকোনো পরিবর্তন মানে বিদ্যমান ক্ষমতার ভারসাম্যে প্রভাব পড়া। একজন মুসলিম নারী যদি তালাকের ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার পান, কিংবা উত্তরাধিকার অংশ সমান হয় - তাহলে সেই পরিবারে ‘পুরুষ কর্তৃত্ব’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সমাজের বহুক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রবল থাকে এবং এই জায়গায় ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও পারিবারিক আইনকে যুগোপযোগী করে নারী অধিকারের দিক থেকে এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেমন তিউনিসিয়ায় পুত্র ও কন্যার সমান উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। মরক্কো ২০০৪ সালের নতুন পারিবারিক আইনে নারীর তালাক, সম্পত্তি ও সন্তান পালনে অধিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে, ভারত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের আইন চালু করেছে। 

একটি রাষ্ট্রের আইন তার নাগরিকদের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য। এটি কখনোই কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা সম্প্রদায়ের সুবিধার্থে তৈরি হতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাস থাকবেই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন হবে যুক্তি, ন্যায় ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে - এটাই হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলনীতি। অভিন্ন পারিবারিক আইন মানে কারও ধর্ম পালনের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়। বরং এটি হবে এমন একটি কাঠামো, যেখানে ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের পারিবারিক আইন সংস্কার এখন আর বিলাসিতা নয় - বরং এটি সময়ের দাবি। ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান দিয়ে, কিন্তু যুক্তিবোধ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পুরনো ব্যাখ্যার সঙ্গে নতুন বাস্তবতার মিল ঘটাতে না পারলে, একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। পারিবারিক আইনের প্রশ্নে আমাদের সাহসী হতে হবে। আমাদের জানতে হবে - ধর্মীয় আবেগকে সম্মান জানিয়ে হলেও, নাগরিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব থেকে সরে আসা রাষ্ট্রের কাজ নয়।

লেখক: মাস্টার অব ইকোনোমিক্স এন্ড পাবলিক পলিসি (ডিস্টিংশন), দ্যা ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। 

ইত্তেফাক/এমএএম