চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অসদুপায় বেড়েছে। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করছেন এক শ্রেণির শিক্ষক। গতকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি পরীক্ষাতেই বই খুলে লেখা, বাইরে থেকে দেওয়াল টপকে কেন্দ্রের ভেতরে নকল সরবরাহ, শিক্ষকের সামনে দেখাদেখি ও আলোচনা করে উত্তরপত্রে লেখার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে শিক্ষকের সামনে বই খুলে পরীক্ষা দেওয়ার ভিডিও। দেওয়াল টপকে পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে। হাতে লিখে প্রশ্নোত্তর সরবরাহের দায়ে একজন শিক্ষকের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। উত্তর বলে দেওয়ায় হল সুপার আটক হয়েছেন। প্রশাসন কঠোর হয়েও নকলের লাগাম টানতে পারছে না। উপরন্তু মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্নফাঁস। প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে পরীক্ষাকেন্দ্র সচিব এক অধ্যক্ষকে আটক করা হয়েছে। পরীক্ষার্থীর হাতে পাওয়া গেছে মোবাইল ফোন। প্রক্সি দিতে এসে গ্রেফতার হয়েছেন এক জন। চারটি পরীক্ষায় ২৭৪ শিক্ষার্থী বহিষ্কার এবং ২১ শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে নকল করার প্রবণতা অনেক সময়ই দেখা যায়। সাধারণত চিরকুটে করা এসব নকল তারা পকেটে বা শরীরের কোথাও লুকিয়ে রাখেন। যুগ যুগ ধরে হাতের তালু, বাহু, জামার উলটো পিঠ, চেয়ার-টেবিল বা দেওয়াল ছাপিয়ে হাল আমলে নকলের এই দৌরাত্ম্য ঠেকেছে মোবাইল ফোন-স্মার্ট গ্যাজেট পর্যন্ত। তবে এবার শিক্ষকদের সহযোগিতায় অসদুপায় বেড়েছে। সমাজতত্ত্ববিদরা নকল বৃদ্ধির পেছনে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকে আঙুল তুলেছেন। তারা বলেন, সমাজে সর্বস্তরে দুর্নীতি বাড়ছে, অসাধুতা ‘স্বাভাবিকতা’য় পরিণত হচ্ছে। এমতাবস্থায় পরীক্ষার্থীদেরও এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। নকল করা বৃদ্ধির যাবতীয় দায় পরীক্ষার্থীদের অসৎ মানসিকতার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আগে তাই আয়নায় নিজেদের দেখে নেওয়া ভালো।
শিক্ষক মো. ইউনুসের দুই বছরের কারাদণ্ড :ফেনীতে দাখিল পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীকে হাতে লিখে প্রশ্নোত্তর সরবরাহের দায়ে মো. ইউনুস নামের এক শিক্ষককে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত ১০ এপ্রিল ফেনী আলিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। ফেনী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুলতানা নাসরিন কান্তা এ দণ্ডাদেশ দেন। সাজাপ্রাপ্ত মো. ইউনুস ফেনী সদর উপজেলার মটুয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
উত্তর বলে দেওয়ার সময় হাতেনাতে হল সুপার আটক :গতকাল চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর বলে দেওয়ার অভিযোগে এক হল সুপারকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। একই ঘটনায় পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে দায়িত্বরত তিন শিক্ষককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে উপজেলার নিজমেহার মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গণিত পরীক্ষা চলাকালে এ ঘটনা ঘটে। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিরুপম মজুমদার জানান, ঐ কেন্দ্রে গণিত পরীক্ষা চলাকালে হল সুপার ও দেবকরা মারগুবা ড. শহীদুল্লাহ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আজমুল হক ১২ নম্বর হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মৌখিকভাবে এমসিকিউ উত্তর বলে দেন। ঐ সময় কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তাকে হাতেনাতে আটক করা হয়। অভিযুক্ত হল সুপার দোষ স্বীকার করেন। দুপুরে শাহরাস্তি থানা-পুলিশ অভিযুক্তকে আটক করে থানায় নিয়ে যান। শাহরাস্তি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আবুল বাসার সাংবাদিকদের বলেন, কেন্দ্র থেকে অভিযুক্ত শিক্ষক আজমুল হককে আটক করে থানায় আনা হয়েছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
প্রশ্নফাঁসে কেন্দ্র সচিবসহ আটক ৬, ট্যাগ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি: এসএসসি পরীক্ষার হল থেকে প্রশ্নপত্র বের করে ফটোকপি করার জন্য দোকানে নেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে একটি চক্র। এরপর কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে অতিরিক্ত প্রশ্নপত্রের মধ্য থেকেও দুটি প্রশ্ন কম পাওয়া যায়। এই দুই ঘটনায় কেন্দ্র সচিব, ট্যাগ কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের বহিরাগত সহযোগীসহ মোট ১০ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ফাজিল মাদ্রাসায় দাখিলের গণিত পরীক্ষা চলাকালে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. পপি খাতুন। আটকরা হলেন—ভূঞাপুর ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও কেন্দ্র সচিব মো. আব্দুস ছোবাহান, বিয়ারা দাখিল মাদ্রাসার পরীক্ষার্থী শাহ আলম ও তার সহযোগী রায়হান আলী, মিজানুর রহমান, লুত্ফর রহমান, সুমন মিয়া। এছাড়া দায়িত্বে অবহেলার দায়ে কেন্দ্রের ট্যাগ অফিসার ও উপজেলা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামানকে অব্যাহতি এবং কক্ষ পরিদর্শকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে জিগাতলা দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক জহুরুল ইসলাম, কোনাবাড়ী দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল হাই এবং নিকলা দড়িপাড়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মোতালেব হোসেনকে।
ছাদ বেয়ে হলে নকল দিতে এসে কারাগারে তরুণ: কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে চলমান এসএসসি পরীক্ষায় ছাদ বেয়ে নকল সরবরাহের দায়ে ইমরান হোসেন (১৯) নামের এক যুবককে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে পেরিয়া ইউনিয়নের ডা. যোবায়েদা হান্নান হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র থেকে তাকে আটক করা হয়। পরে বিকালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাফিদ খান এ দণ্ডাদেশ দেন।
বোনের পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে কলেজছাত্রী আটক: গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে এসএসসি পরীক্ষায় প্রক্সি দেওয়ার চেষ্টাকালে শাহারিয়ার জান্নাতি অনামিকা (১৯) নামক এক কলেজছাত্রীকে আটক করা হয়েছে। ১৭ এপ্রিল উপজেলার সুতি মাহমুদ মডেল পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ১১২ নম্বর কক্ষে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মামলার পর তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। গ্রেফতার শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের জানান, অসুস্থ মামাতো বোনের পরিবর্তে পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি।
ইংরেজি প্রথম পত্রের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ :গত মঙ্গলবার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় এসএসসির ইংরেজি প্রথম পত্রের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরীক্ষা শুরুর ২০ মিনিটের মধ্যেই সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের ‘আমাদের চৌহালী গ্রুপ’ নামে একটি গ্রুপে উল্লিখিত পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটি আপলোড করা হয়। চৌহালী উপজেলা প্রশাসন তত্পর হলে বেলা ১১টার দিকে গ্রুপ থেকে আপলোডকারীরা ঐ প্রশ্নপত্র সরিয়ে ফেলে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়ভাবে তোলপাড় শুরু হলে গ্রুপের অ্যাডমিন মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রযুক্তি আইনে ব্যবস্থা নিতে ওসিকে নির্দেশ দেন চৌহালীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোস্তাফিজুর রহমান। তবে এ ঘটনার প্রভাব পরীক্ষায় পড়েনি বলে দাবি করেন ইউএনও নিজেই। এছাড়া কুমিল্লাতেও প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষকের সামনেই বই খুলে উত্তর লেখার ভিডিও ভাইরাল :অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে গত ১০ এপ্রিল এবারের এসএসসি শুরুর দিনই বাংলা প্রথম পত্রে ২২ জন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। টাঙ্গাইলের কালীহাতি উপজেলার নারান্দিয়ায় তোফাজ্জল হোসেন তুহিন কারিগরি স্কুল কেন্দ্রে একটি কক্ষের অনেক শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের সামনেই বই খুলে উত্তর লেখার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ঐ ভিডিও প্রকাশের পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে দেশ জুড়ে। এছাড়া কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার থানাহাট এ ইউ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেওয়াল টপকে পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে।