শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

মির্জা আজমের এপিএস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পলাতক থাকায় বরখাস্ত

আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৩:৩৯

জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবিপ্রবি) বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রভাষক ইলিয়াস উদ্দিনকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা এবং পলাতক থাকার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ নূর হোসেন চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

মোহাম্মদ নূর হোসেন চৌধুরী স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে এই বরখাস্তাদেশ কার্যকর হয়। গত ২২ এপ্রিল তাকে বরখাস্ত করা হয়। 

অফিস আদেশে বলা হয়, ইলিয়াস উদ্দিন গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে টানা ৬০ দিনেরও বেশি সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন এবং যথাযথ প্রমাণ ছাড়া অসুস্থতার অজুহাতে ছুটির আবেদন করেছিলেন। 

এতে তাকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ৩ (গ) ধারা অনুযায়ী ‘পলায়নের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করে ১২(১) ধারা অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তকালীন তিনি কেবল খোরপোষ ভাতা পাবেন। একই সঙ্গে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও রাখা হয়েছে।

জানা যায়, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ইলিয়াস উদ্দিনের পরিচয় কেবল একজন শিক্ষক হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়। 

তিনি জামালপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজমের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের সাবেক পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক এবং বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদ-এর সাধারণ সম্পাদক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার সময় তার সিজিপিএ ছিল নির্ধারিত মানদণ্ডের নিচে, তবুও তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিক চাপে তাকে নিয়োগ দিতে বাধ্য করা হয়। যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ এখানেই শেষ হয়নি— তিনি তার স্ত্রী আফসানা আক্তারকে অযোগ্য হলেও অ্যাডহকের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে চাকরি পাইয়ে দেন, যদিও এর কোনো অনুমোদন ছিল না ইউজিসির।

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঠেকাতে নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। রাজপথে নেমে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্ট সরকার পতন হলে পালিয়ে থাকছেন যার ফলে সে আর ক্যাম্পাসে আসেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত না থাকা এই শিক্ষক মূলত ঢাকাতেই অবস্থান করতেন এবং বছরে হাতে গোনা কয়েকটি দিবস বা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। একাধিক শিক্ষার্থী জানান, তাদের পুরো সেমিস্টারে তিনি একবার বা দুবার ক্লাস নিয়েছেন মাত্র। তার কোর্সের ক্লাস নিতেন অন্য শিক্ষকরা।

অভিযোগ রয়েছে, সমাজকর্ম বিভাগের হোসাইন মাহমুদ আপেলসহ আরও কিছু শিক্ষকদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের একটি ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে তুলে প্রভাব খাটাতেন এই ইলিয়াস উদ্দিন। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয়ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া হতো বলে জানা যায়।

অভিযোগে রয়েছে, যে কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলে পদোন্নতি, ক্লাস লোড, গবেষণা বরাদ্দ বন্ধসহ নানা হয়রানির শিকার হতেন। এমনকি ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে হুমকি দেওয়া হতো। বিশেষ কোনো ঘটনা বা গণ্ডগোল হলেও অভিযুক্ত ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পেতেন না কেউ। ছাত্রলীগের আহ্বায়ক স্বাধীন-পলাশের গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করতেন আর তাদের পেছনের শক্তি হিসাবে থাকতেন তিনি।

এছাড়া ছুটি না নিয়েই ২০২৩ সলে ইলিয়াস স্ত্রীসহ ভারত সফরে যান। সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশের পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তৎকালীন ভিসির নির্দেশে তড়িঘড়ি করে তৎকালীন রেজিস্ট্রার পূর্বের তারিখ (ব্যাক ডেট) দিয়ে আদেশ জারি করেন বলে জানা যায়।

ইলিয়াস উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার মোমেনাবাদ গ্রামে। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগে যুক্ত হন, পরে মির্জা আজমের ঘনিষ্ঠ হয়ে দ্রুত উত্থান ঘটে তার। এরপরই তার হঠাৎ উত্থান শুরু হয়। গ্রামে দালানকোঠা, ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে দামি ফ্ল্যাট, গাড়ি—সবকিছুই অর্জিত হয়েছে গত ১০-১৫ বছরের মধ্যে। অথচ সরকারি চাকরি সূত্রে এ সম্পদের উৎস প্রশ্নবিদ্ধ।

এদিকে ইলিয়াস উদ্দিনের সাময়িক বরখাস্তের ঘটনা কেবল একজন অনুপস্থিত শিক্ষককে বরখাস্তের ঘটনা নয়—এটি পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার রাজনৈতিক প্রভাব, নিয়োগ বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার একটি প্রতিচ্ছবি বলে মনে করছেন অনেকে।

কেউ কেউ বলছেন, যে শিক্ষক ক্লাসে ছিলেন অনিয়মিত, শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিচিত, অথচ ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন—তার বহিষ্কার হয়তো প্রশাসনিক শৃঙ্খলার সূচনা, তবে যদি তদন্ত ও বিচার না হয়, তাহলে এটি এক দিনের শিরোনাম হয়েই থাকবে।

ইত্তেফাক/পিএস