বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

রানা প্লাজা ধসের ১২ বছর

ফুলবাড়ীর রেবেকা যেন জীবন্ত লাশ, শাবানার প্রতীক্ষায় প্রিয়জন

আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৩৫

আজ ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধসের একযুগ পূর্ণ হলো। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের ওই ভবন ধসে অন্তত ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। তবে এক যুগ পার হয়ে গেলেও এখনো দগদগে ক্ষত হয়ে আছে সেদিনের স্মৃতি। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের অনেকে এখনো আতঙ্কগ্রস্ত। বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন পথ খুঁজে নিয়েছেন কেউ কেউ। জীবনযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।

একই ঘটনায় দুই পা হারিয়েছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর রেবেকা বেগম। দুই হাতের ওপর ভর করে চলছে তার জীবনের পথচলা। সাভারের রানা প্লাজা ধসের দিনে ভবনের ষষ্ঠতলায় মায়ের সঙ্গে পোশাক শ্রমিকের কাজ করছিলেন রেবেকা। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। তবে দুর্ঘটনায় উরু পর্যন্ত দুই পা হারান তিনি। দীর্ঘ ১১ মাস হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার বারাইহাট চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে ফেরেন তিনি। এরপর কেটে গেছে এক যুগ। এরই মধ্যে দুই সন্তানের মা হয়েছেন তিনি।

এখন কেমন আছেন সেই রেবেকা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। রানা প্লাজা ধসের সেই ভয়াল স্মৃতি এখনো বহন করে চলছেন তিনি। তবে স্বামী মোস্তাফিজুর রহমানের সেবা-ভালোবাসা ও সহযোগিতায় হাসিমুখে দিন কাটছে তার। দুই হাতের ওপর ভর করেই ঘর-গৃহস্থালির কাজ করাসহ মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহা (১০) ও ছেলে মাদানী আল নূরকে (৬) দেখভাল করছেন। 

সেদিনের ধসে মা চান বানুসহ দাদি, ফুফুকে হারিয়েছেন তিনি। সাভারে তার স্বামী মোস্তাফিজুর রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন সেসময়। দুর্ঘটনার দিন রানা প্লাজার পাশেই কাজে ছিলেন তিনি। খবর পেয়ে স্ত্রীকে ফোন করেন তিনি। তবে সাড়া পাননি। এরপর ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। স্ত্রীকে খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক ছুটতে থাকেন।

মোস্তাফিজুর বলেন, ‘আল্লাহকে বলেছিলাম জানের বদলে জান দেব, তবু স্ত্রীকে ফেরত দাও। জীবিত অবস্থায় ফেরত পেয়েছি স্ত্রীকে। আমি নিজেও এতিম, তাই এতিম দেখেই ভালোবেসে বিয়ে করেছি। ওর মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব নিয়েছি। অনেকে মনে করেছিলেন, ওকে ছেড়ে আমি চলে যাব। তবে যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, তাকে ছেড়ে যাব কীভাবে? ওর জন্য খুব কষ্ট হয়। দূরে কোথাও কাজকামেও যেতে পারি না।’

সেই দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছেন রেবেকা। প্রতি মাসে সেখান থেকেই ৯ হাজার ১০০ টাকা করে পান তিনি। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও সংসারের খরচও চলছে সেই টাকায়।

রেবেকা বলেন, দুর্ঘটনায় যার দুই পা হারিয়েছে, তাকে দেওয়া হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এক পা হারালে ১০ লাখ। কিন্তু ভুল প্রতিবেদন দেওয়ায় দুই পা হারিয়েও এক পা হারানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন তিনি। স্বামী কাজে যেতে পারেন না। দুই ছেলেমেয়ের জন্য হলেও বাকি ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়ার দাবি জানান রেবেকা।

এদিকে, গুলশানে জান্নাত শাবানা (২৭) রানা প্লাজার ষষ্ঠতলায় সুয়িং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। তার স্বামী আতাউর রহমান পাশেই এনাম মেডিকেলে নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে চাকরি করতেন। সেদিনের ঘটনা চোখের সামনে দেখেছন তিনি। দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তিদের কাছে ছোটাছুটিও করেছেন তিনি। জীবিত মানুষদের কাছে স্ত্রীর খোঁজ করেছেন। তবে ১২ বছর কেটে গেলেও স্ত্রীকে খুঁজে পাননি আতাউর।

জানা যায়, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার কাজিহাল ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে আতাউর-শাবানা দম্পতির বাড়ি। মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) বিকেলে আলাপচারিতায় আতাউর রহমান বলেন, দুই সন্তান, স্ত্রী আর মাকে নিয়েই সংসার ছিল তার। ছেলেমেয়েকে দাদির কাছে রেখে ঢাকায় চাকরি করতেন স্বামী-স্ত্রী। সেসময় ছেলের বয়স পাঁচ আর মেয়ের তিন বছর ছিল।

আতাউর বলেন, ভবন ধসের পাঁচ মাস পর এলাকায় ফিরে আসেন। ছেলেটা মায়ের কথা কিছুটা হলেও বলতে পারে। মায়ের জন্য প্রথম প্রথম খুব কান্নাকাটি করত। তবে মেয়ের তেমন কোনো স্মৃতি নেই মাকে নিয়ে। এলাকায় ফিরে সন্তানদের মায়ের কাছে রেখেই কৃষিকাজ শুরু করেন তিনি। তবে আট বছর আগে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সন্তান লালন-পালনে খুব সমস্যায় পড়েন সেসময়। সন্তানদের কথা চিন্তা করেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন তিনি। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় নাম ছিল শাবানার। আতাউর ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছেন ১৩ লাখ টাকা।

ছেলেমেয়ে নতুন মায়ের কাছে ভালোই আছে উল্লেখ করে আতাউর বলেন, ‘টাকা হয়তো পেয়েছি, তবে ১২ বছরেও স্ত্রীর মরদেহটাও দেখতে পাইনি। মেয়ে সানু এখন এইচএসসি পড়ছে। আর ছেলেটাও দশম শ্রেণি পড়ছে। আজ ওদের মা বেঁচে থাকলে কত খুশি হতো। কত সুন্দর সংসার ছিল আমাদের’, বলতে বলতে অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন আতাউর রহমান।

ইত্তেফাক/এনটিএম/এএইচপি