বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস 

প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষায় ভেটেরিনারিয়ানদের পাশাপাশি প্রয়োজন দলগত প্রচেষ্টা

আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:১৭

ভেটেরিনারিয়ান বা ভেট মূলত তাদেরই বলা হয়, ধরনের প্রাণী ও পোলট্রির চিকিৎসা করে থাকেন। এই প্রাণিসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের জন্য বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস একটি বিশেষ দিন। প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ শনিবার সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিনা মূল্যে প্রাণীর চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান, টিকাদান কর্মসূচির মতো আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ পালন করে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। ২০০১ সালে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন ভেটেরিনারি পেশার সঙ্গে কর্মরত সব ভেটেরিনারিয়ানের জন্য একটি বিশেষ দিন আয়োজনের প্রস্তাব করে, যেটা নির্ধারিত হয় প্রতি বছরের এপ্রিলের শেষ শনিবার।

সেই হিসেবে এবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫ পালিত হবে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। বাংলাদেশে ২০০৪ সালে ঢাকার সেন্ট্রাল ভেটেরিনারি হাসপাতালে প্রথম বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস পালিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (বিভিএ), প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থা যৌথভাবে দিনটি উদযাপন করে থাকে।

দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘Animal Health Takes a Team’। এই প্রতিপাদ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষা শুধু একজন ভেটেরিনারিয়ান বা প্রাণী চিকিৎসকের দায়িত্ব নয়, এটি একটি সমন্বিত দলীয় প্রচেষ্টা। এই সমন্বিত প্রচেষ্টা ‘One Health’ ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত, কেননা মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশ এই তিনের স্বাস্থ্য একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোনো প্রাণীর অসুখ যদি মানুষে সংক্রমণ ঘটায় (যেমন জুনোটিক রোগ), তাহলে তা শুধু খামার নয়, গোটা সমাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। যার প্রমাণ আমরা সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারিতে পেয়েছি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিগত তিন দশকে ইমার্জিং ভাইরাসঘটিত রোগের ৭৫ শতাংশই প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে। ফলে শুধু প্রাণী চিকিৎসক নয়, মানব স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, সচেতন নাগরিক সবার একসঙ্গে কাজ করাটাই এখন সময়ের দাবি। ভেটেরিনারি দিবসটির লক্ষ্য ভেটেরিনারি পেশাকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, প্রাণী, পরিবেশ ও মানুষের উন্নয়নে কাজ করা, খাদ্যনিরাপত্তা এবং প্রাণী পরিবহন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখা। মানুষ ও প্রাণীর কল্যাণ নিশ্চিত করাই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য।

আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনায় যেখানে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি বা পোষা প্রাণীদের স্বাস্থ্যই নির্ধারণ করে সেই খামারের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, সেখানে একজন প্রাণী চিকিৎসকের ওপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে ফলাফল সন্তোষজনক হয় না। একজন প্রাণী চিকিৎসক হয়তো সঠিক ডায়াগনোসিস দিতে পারেন, কিন্তু খামার মালিক যদি সময়মতো চিকিৎসা না দেন বা সঠিকভাবে ওষুধ প্রয়োগ না করেন, তাহলে পুরো প্রচেষ্টাটাই ব্যর্থ হয়। একটি প্রাণীর সুস্থতা নির্ভর করে চিকিৎসক, খামার মালিক, প্রাণিপালক, খাদ্য প্রস্তুতকারী, ওষুধ সরবরাহকারী, গবেষক, মাঠকর্মী এমনকি স্থানীয় জনগণের ওপরও। সবার সচেতনতা ও সমন্বয় ছাড়া টেকসই প্রাণী স্বাস্থ্য নিশ্চিত অসম্ভব।

মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিকুলের সুস্থতা প্রয়োজন সবার আগে। এজন্য প্রাণিস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (WVA) যৌথভাবে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথ (OIE), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (FAO)-এর সঙ্গে সারা বিশ্বে কাজ করে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের দিক বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, হিউম্যান মেডিক্যাল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি মেডিক্যাল সায়েন্সকে একীভূত করে ওয়ান হেলথ ইস্যুতে কাজ করছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ভেটেরিনারি ডাক্তার ও মেডিক্যাল ডাক্তারদের তেমন সমন্বয় নেই বললেই চলে। উভয়েই সমন্বয় সাধন করে কাজ করলেই হতে পারে প্রাণিসম্পদ তথা মানবসম্পদের কল্যাণ।

দেশের মোট প্রাণিজ আমিষের ৭৬ শতাংশ আসে ডিম, দুধ ও মাংস থেকে। যেগুলোর উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন ভেটেরিনারিয়ানরা। গত ১০ বছরে দেশে ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। পোলট্রি খাত এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প, ডেইরি ইন্ডাস্ট্রিও প্রতিষ্ঠিত শিল্প। এসবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। প্রাণিসম্পদের এই উন্নয়নের পেছনে কাজ করে চলেছে ভেটেরিনারিয়ানরা।

বাংলাদেশের মতো প্রাণিসম্পদনির্ভর অর্থনীতিতে যেখানে লাখ লাখ মানুষ খামার ও প্রাণী পালনের সঙ্গে জড়িত, সেখানে প্রাণীর কল্যাণে আরও সুসংগঠিত দল গঠন, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানো উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকেই ছাত্রছাত্রীদের টিমওয়ার্কের ধারণা দেওয়া উচিত, যাতে তারা মাঠে গিয়ে একসঙ্গে কাজ করার বাস্তবতা বুঝতে পারে। প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষায় দায়িত্ববান মালিক, দক্ষ চিকিৎসক, সৎ ওষুধ বিক্রেতা, সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত মাঠকর্মী এবং সর্বোপরি একটি সচেতন সমাজ সব মিলেই হতে পারে একটি শক্তিশালী টিম। এই টিমের সম্মিলিত চেষ্টাতেই গড়ে উঠবে একটি টেকসই প্রাণিসম্পদ খাত, যা দেশের অর্থনীতি, পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হবে আশীর্বাদ।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভেটেরিনারিয়ান

ইত্তেফাক/এসএএস