বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

ঢাকার দুই সিটিকে একীভূত করার প্রস্তাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

নতুন কাঠামোয় মহানগর সরকার ও সিটি কাউন্সিল গঠনের সুপারিশ, বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকদের নানা মত

আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৪

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ—বর্তমানে বিভক্ত দুই সিটি করপোরেশনকে পুনরায় একীভূত করে একটি একক মহানগর সরকার গঠনের সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। গত ২০ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তরিত চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কমিশনের ভাষ্যে, বিভক্ত সিটি করপোরেশন কাঠামোতে কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আর এই বিভাজন ঢাকার প্রশাসনিক জটিলতা, দায়িত্বের দ্বন্দ্ব ও সেবা বিভ্রান্তি বাড়িয়ে তুলেছে।

এ ছাড়াও প্রতিবেদনে ঢাকাকে একীভূত করে একটি একক সিটি করপোরেশন গঠনের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক ‘সিটি কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান উত্তর ও দক্ষিণ সিটির আওতায় থাকা ২০টি অঞ্চলকে ভিত্তি করে স্বতন্ত্র ২০টি সিটি কাউন্সিল গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিটি সিটি কাউন্সিল গঠিত হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ডগুলো নিয়ে। 

এতে বলা হয়— প্রতিটি কাউন্সিলে ৯ থেকে ১৫টি ওয়ার্ড থাকবে, যা জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। এসব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা নির্বাচিত হবেন সরাসরি জনগণের ভোটে। তবে সিটি কাউন্সিল এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হবেন পরোক্ষভাবে—কাউন্সিলরদের ভোটে। কমিশনের মতে, এই পদ্ধতি সেবা প্রদানে তৃণমূল অংশগ্রহণ, দায়বদ্ধতা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করবে। কেন্দ্রীয় করপোরেশন থাকবে একটি সমন্বয়কারী ও নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে।

কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে আট সদস্যের এই টিম বলেছে, গত ১৩ বছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে বিভক্ত থাকলেও কাঠামোগত জটিলতা, সমন্বয়হীনতা এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নাগরিক সেবা ব্যাহত হয়েছে। তাই পুনরায় একীভূত করে অঞ্চলভিত্তিক কাউন্সিলের মাধ্যমে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দেওয়াই সমাধান হতে পারে।

তাদের মতে, এই কাঠামোয় যেমন দায়িত্ব ভাগ হবে, তেমনি নিরীক্ষা ও জবাবদিহিতা সহজতর হবে। নাগরিকদের সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে নির্দিষ্ট এলাকায় স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ইউনিট থাকলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দ্রুত হবে এবং প্রশাসন হবে আরও জনমুখী।

তবে এ প্রস্তাবকে ঘিরে নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন ভিন্নভাবে। তাদের মতে, মূল সমস্যা কাঠামোগত নয় বরং প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্নীতির সংস্কৃতি।

নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, একাধিক সিটি থাকলে দায়িত্ব বণ্টন সহজ হয়, তবে সঠিক সমন্বয় ও দক্ষতা না থাকলে তা কোনো কাজে আসে না। একে এক করা বা দুইয়ে ভাগ করার বিষয় নয় বরং দরকার দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত ও জনমুখী প্রশাসন।

এই প্রস্তাব নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মাঝেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকে মনে করছেন, দুই মেয়রের সমন্বয়হীনতায় নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে, আবার কেউ বলছেন কাঠামো বদল না করে প্রশাসনের সদিচ্ছা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই জরুরি।

উত্তরার বাসিন্দা মনিরুজ্জামান বলেন, দুই মেয়রের সমন্বয়ের অভাব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। অনেক সময় রাস্তা খোঁড়া হয় এক মেয়রের আওতায়, কিন্তু মেরামত হয় না অন্যজনের দায় না নেওয়ায়। এক হলে হয়তো সমন্বয় বাড়বে, তবে দুর্নীতির সংস্কৃতি না ভাঙলে কিছুই হবে না।

মিরপুরের এক স্কুলশিক্ষিকা ফারজানা হোসেন বলেন, সিটি এক হোক বা দুই, মশা মরছে না, রাস্তা ঠিক হচ্ছে না। দায়িত্বপ্রাপ্তদের সদিচ্ছা না থাকলে কাঠামো দিয়ে কিছু হবে না। মানুষ চায় পরিষ্কার রাস্তা, নিরাপদ চলাচল, সঠিক সেবা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবীর প্রস্তাবিত কাঠামোর কিছু বিষয়ে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, ঢাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় দুটি সিটি করপোরেশন নাগরিক সেবা নিশ্চিতের দিক থেকে যুক্তিযুক্ত। তবে সিটি করপোরেশনগুলোকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য একটি কার্যকর আইনি কাঠামো থাকা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মেয়র সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ভবিষ্যতে যদি মেয়র নির্বাচন কাউন্সিলরদের মাধ্যমে হয়, তবে তা জনগণের সরাসরি ভোটাধিকার খর্ব করবে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী।

ইত্তেফাক/এমএএম