মিল্টন বিশ্বাস
বাংলাদেশের নৌ-ইতিহাসের বয়স মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে সমুদ্র বাণিজ্য এবং নৌবাহিনী গঠনের ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন। সেই ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের সমুদ্র বন্দরের সম্পৃক্ততা রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে নৌবাণিজ্য রক্ষায় নৌবাহিনীর ভূমিকা অনন্য। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় ভারত থেকে সংগৃহীত ‘পদ্মা ও পলাশ’ নামে দুটি পেট্রোল ক্রাফট নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ঈসা খানকে প্রথম ‘নেভাল এনসাইন’ দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় জলসীমার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য ২০১৬ সালে নৌবাহিনী স্বাধীনতা পদক পেয়েছে।
‘শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়’ এই মহিমান্বিত বাণীর ধারক-বাহক নৌবাহিনীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো শক্তিশালী দেখতে চান। ইতিমধ্যে নৌবহরে যুক্ত হয়েছে আরো নতুন নতুন যুদ্ধজাহাজ। প্রথমবারের মতো এসেছে দুটি অত্যাধুনিক সাবমেরিন। এছাড়া সরকারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হাতে নেওয়া হয়েছে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ কার্যক্রম। নৌবাহিনীকে আরো আধুনিকায়নের লক্ষ্যে চীনে নতুন দুটি করভেট নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এজন্য নতুন যুদ্ধজাহাজ কমিশনিংয়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিশাল সমুদ্র সম্পদ রক্ষা করবে নৌবাহিনী। তাঁর মতে, ভৌগোলিক অবস্থানগত ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের জলসীমা ও তার সম্পদ রক্ষায় নৌবাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। উপকূলীয় এলাকার নিরাপত্তা বিধান নৌবাহিনীর একটি অন্যতম কাজ।
মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসার পর বঙ্গোপসাগরে সুবিশাল অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে সমুদ্র নিরাপত্তার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এই এলাকায় অবাধে মাছ শিকার ও অন্যান্য সম্পদ আহরণ করা যাচ্ছে। ওশানগ্রাফি ও ব্লু ইকোনমির ওপর কাজ শুরু হয়েছে। সাগরে আমাদের এখন ৬০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। সমুদ্রকে ঘিরে কর্মসংস্থানের বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রের সম্পদ লুণ্ঠনে অন্যরা শ্যেনদৃষ্টি ফেলছে, জলদস্যুরা টার্গেট নিয়ে আছে। প্রয়োজন একটি বহুবিধ ক্ষমতাসম্পন্ন ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীর।
বাংলাদেশের সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা ও দুর্যোগ মোকাবিলায় নৌবাহিনীর দায়িত্ব অনেক। দেশের বিশাল জলসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি সমুদ্রে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান রোধ, গভীর সমুদ্রে উদ্ধার তত্পরতা বৃদ্ধি, মত্স্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্লকসমূহে অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি সার্বিকভাবে দেশের ব্লু ইকোনমির উন্নয়নে এ বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। ক্রমাগত সম্পদ আহরণের ফলে বিশ্বের স্থলভাগের সম্পদ আজ সীমিত। তাই সারাবিশ্ব এখন নতুন সম্পদের খোঁজে রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ব্লু ইকোনমির মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ৯৫ শতাংশ সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে।
সমুদ্র বাণিজ্যের গতিপথ নিশ্চিত করার জন্য দরকার চোরাচালান রোধ, রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য বিদেশিদের অনুপ্রবেশ বন্ধকরণ, জলদস্যুতা ও অন্যান্য অপরাধ দমন করা। তেমনি বন্দরকে রক্ষা করা দরকার। আর এসব কাজ নৌবাহিনীকে করতে হচ্ছে। নৌবাহিনীর হস্তক্ষেপে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দুর্নীতিমুক্ত হয়ে আমদানি রপ্তানির প্রক্রিয়া গতিশীল হয়েছে। নৌবাহিনীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় নদী ড্রেজিংকরণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো আজ মোংলা বন্দরে নিরাপদে ভিড়তে পারছে এবং দুর্বৃত্তদের কবলমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক মাল খালাস প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হয়েছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সাফল্য দেখিয়েছে। নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। বাংলাদেশের জলসীমার পরিধি বিস্তৃতি লাভ করায় নৌসদস্যদের দায়িত্ব আরো বেড়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এই বাহিনীর জন্য ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ প্রণয়ন করে। অর্থাত্ যুদ্ধক্ষেত্রে স্থলপথে, আকাশপথে ও সমুদ্রপথে একইসঙ্গে কার্যকরভাবে অপারেশন পরিচালনার দক্ষতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে একটি ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১২ সালে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ নামে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রভূত উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে অত্যাধুনিক নৌবহর, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার, অত্যাধুনিক ফ্রিগেট শিপ, করভেট শিপ, মাইন সুইপার, পেট্রোল ক্রাফট, অয়েল ট্যাংকার, নেভাল এভিয়েশন, গবেষণা ও জরিপ জাহাজ এবং এক দল দক্ষ ও অকুতোভয় নৌসদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী রূপে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে বাংলাদেশের জলসীমার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিজেদের তথা বাংলাদেশকে সম্ভাব্য দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের উত্থান বিবেচনা করে দেশের নৌবাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের অভিযানে নেভি শিল্ডের অংশগ্রহণ ও জঙ্গি নির্মূলের কথা কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন প্রায় ১,১১,৬৩২ বর্গকিলোমিটার। এই সীমার আওতায় প্রচুর পরিমাণে মাছ, সমুদ্রজাত উদ্ভিদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে যা আমাদের দেশের বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার সম্পূর্ণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন এই সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও ব্যবহার। বাংলাদেশ নৌবাহিনী এজন্যই কাজ করছে। এছাড়াও সাংগু উপকূলীয় গ্যাস ফিল্ডের ওপর ভিত্তি করে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সামুদ্রিক অঞ্চলে আমাদের গ্যাস আহরণের কিংবা খনিজ তেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা খুবই বেশি যা আমাদের জলসীমার গুরুত্ব আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত দেশীয় জেলেদের সহযোগিতা এবং সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বিদেশি জাহাজগুলোকে নিরাপদে বন্দরে পৌঁছানো এবং সাংগু গ্যাস ক্ষেত্রের স্থাপনা ও পাইপলাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নৌসদস্যরা দেশের দুর্জয় কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করছে।
বিশাল সমুদ্র নৌবাহিনীর কর্মক্ষেত্র। লোকচক্ষুর অন্তরালে উত্তাল সমুদ্রে দিবারাত্রি কঠোর পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করেছেন, দেশবাসী তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিভিন্ন জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের তত্পরতা সকলের প্রশংসা অর্জন করেছে। কেবল সমুদ্র বাণিজ্য রক্ষায় নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এখন অনেক বেশি কার্যকর, শক্তিশালী এবং গতিশীল বাহিনী হিসেবে পরিচিত।
n লেখক :অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়