হামাস ও ফিলিস্তিনের মধ্যে অস্ত্রবিরতি মার্চে ভেঙে পড়ে। অস্ত্রবিরতি সমঝোতাকে বদাসুলি দেখিয়ে ইসরায়েল আবারও নিবিচার মামলা শুরু করে। এ অবস্থায় এই ধারণা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়। একই সঙ্গে এ ঘটনা এধারণাও জোরদার করে যে, শেষ পর্যন্ত সব পক্ষকে শান্তির দিকেই আসতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পই হতে পারেন একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট যার পক্ষে আপাত অসাধ্য এই কাজটি করা সম্ভব।
৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর ইসরায়েল বাছবিচারহীন এলোপাতাড়ি বোমা বর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার সময়ও ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেন ইসরায়েলকে সামরিক সরঞ্জামাদি পাঠিয়ে গেছেন। ২০২৪ সালের মে মাসে একটি অস্ত্রবিরতি বাস্তবায়ন করার সুযোগ আসার পরও বাইডেন প্রশাসন সেটি কাজে লাগাতে পারেনি। অথচ ট্রাম্পের কথায় নেতানিয়াহু এ বছর জানুয়ারিতে একই অস্ত্রবিরতি করতে রাজি হন।
ট্রাম্প দেখিয়েছেন যে, নেতানিয়াহুকে রাজি করানোর ক্ষমতা তার আছে। তিনি জানেন নেতানিয়াহু চান কোয়ালিশন শরিক দলকে না হারিয়ে অস্থায়ী অস্ত্রবিরতি করে হলেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে গাজায় এখনো যে কয়েকজন জিম্মি আছে তাদের ছাড়িয়ে আনার বিনিময়ে তা করা সম্ভব। এর মাধ্যমে তিনিও দেখাতে পারবেন যে, ট্রাম্প ইসরায়েলের স্বার্থের বিপক্ষে নন। ফিলিস্তিনিদের দিক থেকে দেখলে এটা বোঝানো সহজ হবে যে, ট্রাম্প বাইডেনের মতো নন। তিনি তার কূটনৈতিক সক্ষমতা সব পক্ষের ওপর প্রয়োগ করেন।
জানুয়ারিতে যে অস্ত্রবিরতি হয়েছে তা তিন স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তর পার হওয়ার চুক্তি কার্যত ভেঙে পড়েছে। এখন দ্বিতীয় স্তরের পুনরুজ্জীবন ঘটানোই ওয়াশিংটনের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। ট্রাম্প ইসরায়েলকে হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসতে বলতে পারেন। এই পর্যায়টি বাস্তবায়নের জন্য ইসরায়েলকে গাজা থেকে পুরোপুরি দৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চুক্তির এই পর্যায় বাস্তবায়নের জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন।
ট্রাম্প প্রশাসন যে গতানুগতিক ধারায় কাজ করে না তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই ভারা দিয়েছে। তারা হামাসের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছে। আবার ঘনিষ্ঠ মিত্রের ওপরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে আভাষ পাওয়া গেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের কথা, তারা যুদ্ধ চায় না। বরং মধ্যপ্রাচ্যে বড় একটি পরিবর্তন আনতে ইচ্ছুক। যার অন্যতম হচ্ছে সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। তবে সৌদি আরব এর মধ্যে স্পষ্ট জানিয়ে রেখেছে, ইসরায়েল যতদিন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিষয়টি মেনে না নিবে ততদিন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।
আরব নেতৃবৃন্দ কায়রোতে মার্চে একটি শান্তি পরিকল্পনা অনুমোদন করেন। এতে বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত না করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত উপত্যকাটি পুনর্নির্মাণ এবং ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি স্থাপনের কিছু দিকনির্দেশনা ছিল। তবে গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি গ্রুপ অস্ত্র-সমর্পণ করবে কি না, সে ব্যাপারে তাতে কিছু বলা হয়নি। পরিকল্পনাটি ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি রূপরেখা হিসেবে গণ্য করা যায়।
ফিলিস্তিনিদের দুটি প্রধান গ্রুপ হামাস ও ফাতাহ। ফাতাহ ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) শাখা সংগঠন যা বর্তমানে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) চালকের আসনে আছে। বলা অনাবশ্যক, এ ধরনের যে কোনো পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের সায় ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ ইসরায়েল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেবে-এমন সম্ভবনা খুবই কম। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলে দেশটি রাজি হতেও পারে।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক হোয়াইট হাউজের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ জানিয়েছেন, ভালো চুক্তি সেটাই যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন। এ সফরে তিনি ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করা ছাড়াও কথা বলেছেন হামাসের প্রতিনিধির সঙ্গে। যেটা তার পূর্বসূরিদের কেউই এ পর্যন্ত করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের জিম্মিবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা অ্যাডাম বোয়েলার অবশ্য সরাসরি হামাসের সঙ্গে কথা বলেছেন। নিউ ইয়র্কের একজন রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার হিসাবে ট্রাম্পের সঙ্গে উইটকফের আগে থেকেই পরিচয় ছিল।
ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসনে দুই রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলে আসলেও তারা প্রথমে ইসরায়েলের সঙ্গে কথা বলে ফিলিস্তিনিদের তার সঙ্গে একমত করানোর চেষ্টা করেছেন। ফলে কোনো শান্তি উদ্যোগই এ পর্যন্ত টেকসই সমাধান আনতে পারেনি। ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে লড়াই শুরু হওয়ার পর সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্রিনকেন ১১ বার মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন। তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহমুদ আব্বাসসহ অন্য আরব নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও হামাসের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। কারণ হামাস যুক্তরাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।
গাজা পুনর্গঠন নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প মন্তব্য করেছিলেন- স্থানীয় লোকজনকে সরিয়ে দিয়ে উপত্যকাটি একটি অবকাশ কেন্দ্রের মতো গড়ে তোলা হবে, তার প্রতিনিধিদের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গেও যেন একে মেলানো যাচ্ছে না। ট্রাম্প যদি ফিলিস্তিনি ও আরবদের তাদের ঘোষিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে দেন তবে এটি ফলপ্রসু হওয়ার সম্ভবনা আছে। পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার স্থিতিশীলতার জন্য হামাস ও ফাতাহর মধ্যে সমঝোতা হওয়া জরুরি।
তবে চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা গেলে দুই বিবদমান ফিলিস্তিনি গ্রুপ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কেড়ে ফেলে দেওয়ার একটি সুযোগ। আবারও উল্লেখ করতে হয়, চুক্তির বাস্তবায়ন নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতির ওপর। যুক্তরাষ্ট্র যদি এতে সায় দেয় এবং ইসরায়েলকে বোঝায় যে, এটি তাদের স্বার্থও রক্ষণ করবে সেক্ষেত্রেই কেবল এই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখতে পারে। কাজটি কেবল ট্রাম্পের পক্ষেই সম্ভব।