বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

বাংলাদেশে প্রথম টার্ন টেবিল তৈরি করে অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন রেলওয়ে তাসরুজ্জামান

আপডেট : ০৫ মে ২০২৫, ২০:১৬

বাংলাদেশে প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন ট্রেনের ইঞ্জিন ও কোচ ঘোরানোর জন্য টার্ন টেবিল তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে 'সিলভার স্টেভি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ পদক পাচ্ছেন লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের প্রকৌশলী তাসরুজ্জামান বাবু।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্টেভি অ্যাওয়ার্ড ইনকরপোরেশন থেকে ‘মোস্ট ইনোভেটিভ টেকনোলজি লিডার অব দ্য ইয়ার’ ক্যাটাগরিতে গত ১৭ এপ্রিল পদকজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আগামী ১৩ মে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই পদকটি তুলে দেওয়া হবে।

তার উদ্ভাবিত স্বয়ংক্রিয় টার্নটেবিলকে স্টেভি অ্যাওয়ার্ড জুরিবোর্ডের সদস্যরা দক্ষিণ-এশিয়ার ‘প্রথম অটোমেটেড টার্নটেবিল’ বলেও অভিহিত করেছেন। এছাড়াও ওই উদ্ভাবনের জন্য ২০২৪ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে তিনি শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবকের স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনআইডিও) স্বীকৃতি সনদ লাভ করেন।

প্রকৌশলী তাসরুজ্জামান বাবু রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন) হিসেবে কর্মরত। তিনি লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগে বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন) হিসেবে ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কয়েকটি উদ্ভাবনের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। এর মধ্যে রেলের কোচ ও ইঞ্জিন ঘোরানোর টার্ন টেবিল অন্যতম। এটি বাংলাদেশে নির্মিত প্রথম টার্ন টেবিল। দেশের আগের টার্ন টেবিলগুলো ব্রিটিশ আমলের বিদেশ থেকে আনা।

লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলস্টেশনের আধা কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে সিক লাইন এলাকায় ৯ শতক জমির ওপর টার্ন টেবিলটির অবস্থিত।

প্রকৌশলী তাসরুজ্জামানের অন্যান্য উদ্ভাবনগুলো হলো: ভাঙ্গন প্রতিরোধী দীর্ঘস্থায়ী হুইলসেট গাইড, রেল দুর্ঘটনায় কোচ ও লোকোমোটিভ উদ্ধার কাজে ব্যবহার্য রি-রেইলিং ইকুইপমেন্টস, কোচের শিডিউল মেরামত করার জন্য প্রথম ইলেকট্রিক লিফটিং জ্যাক।

প্রকৌশলী তাসরুজ্জামান ৩৫তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী যান্ত্রিক প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চাঁপাইনবাবগঞ্জে। শিক্ষা জীবনে তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে প্রদত্ত এডিবি-জেএসপি স্কলারশিপ নিয়ে জাপানের ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইন্সটিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ (গ্রিপ্স) থেকে পাবলিক পলিসিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে লালমনিরহাটে টার্ন টেবিল না থাকায় মিটারগেজে চলমান ইঞ্জিন ও কোচ কয়েক মাস পরপর ঢাকার কমলাপুরে টার্ন টেবিলের মাধ্যমে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হতো। এটি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে কোচবিহীন হালকা ইঞ্জিন পারাপার ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য এর সঙ্গে কিছু কোচ সংযুক্ত করতে হতো।

চালক যদি ইঞ্জিনের পেছনে বসেন, তাহলে রেল লাইনের সংকেত (সিগন্যাল) দেখতে অসুবিধা হয়। এতে ট্রেনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। ইঞ্জিন ঘুরানোর এই সমস্যা আর হয় না। এছাড়া একটি কোচ বা ইঞ্জিনকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর টার্ন টেবিলের ওপর রেখে ঘোরানো হয়। এতে বাঁ দিকের চাকা ডান দিকে, ডান দিকের চাকা বাঁ দিকে চলে যায়। ফলে দুই পাশের চাকা সমানভাবে ক্ষয় হয়। এতে চাকার স্থায়িত্ব বাড়ে।

এ ব্যাপারে লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী তাসরুজ্জামান বাবু সাংবাদিকদের জানান, স্বল্প খরচে, দেশীয় প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তায় এসব উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। যা ১২২ বছরের পুরনো লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের কাজের পরিবেশ বদলে দিয়েছে। আমার উদ্ভাবনগুলোতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নিজস্ব সমাধান বের করে নেওয়ার যে মেসেজ ছিল, তা জুরিবোর্ড পছন্দ করেছেন। তাই আমাকে ওই পদকের জন্য মনোনীত করেছেন।

প্রকৌশলী তাসরুজ্জামানের সাফল্যে খুশি হয়ে তার মা তাহমিনা বেগম জানান, আমার ছেলে ১২বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে। অনেক কষ্ট করে তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। ছেলের সাফল্যের খবরে আমি খুব খুশি হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। দোয়া করি, ছেলেটা দেশের জন্য আরও কাজ করুক, আরও সুনাম বয়ে আনুক।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের (রাজশাহী) প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী সাদেকুর রহমান জানান, প্রকৌশলী তাসরুজ্জামানের উদ্ভাবনসমূহ রেলওয়ের কাজকে সহজ ও গতিশীলতা বৃদ্ধির সহায়ক। তাঁর উদ্ভাবনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভে আমরা খুশি।

ইত্তেফাক/এএইচপি