রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

তালগাছের রসে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি

আপডেট : ০৯ মে ২০২৫, ১০:৫৭

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে তালগাছ নিয়ে যেন নতুন এক জাগরণ শুরু হয়েছে। আগে অবহেলার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত এই গাছ এখন হয়ে উঠেছে গ্রামের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। গ্রীষ্মকালীন তালরস আহরণের মাধ্যমে কৃষকেরা পাচ্ছেন নতুন আয়ের পথ, তৈরি হচ্ছে স্বনির্ভরতার দৃষ্টান্ত।

তালগাছের পরিচিতি আমাদের লোকসাহিত্যে দীর্ঘকাল ধরেই আছে। শিশু সাহিত্যিক জসীম উদ্দীন একে বর্ণনা করেছিলেন "এক পায়ে দাঁড়িয়ে আকাশে উঁকি মারা" গাছ হিসেবে। বাস্তবেও তালগাছ যেন নীরবে দাঁড়িয়ে গ্রামীণ জীবনের পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে উঠেছে। এক সময় এই গাছ কাটা হতো অপ্রয়োজনীয় ভেবে। এখন সেটিই কৃষকের জন্য ‘প্রাকৃতিক সেফটি’ এবং জীবিকার উৎস।

কালীগঞ্জ উপজেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক ইলিয়াস আলী প্রতিদিন তিনবার তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। তিনি আরও বলেন প্রতিটি গাছ থেকে দিনে ১৫ থেকে ২০ লিটার পর্যন্ত রস পাওয়া যায়।

“এই রস দিয়েই আমি সুগন্ধি গুড় তৈরি করি। স্থানীয় বাজারে এর খুব চাহিদা। সংসারের খরচ এখন এই রস থেকেই উঠে আসে।”
তার মতো অনেক কৃষক এখন গ্রীষ্মকালে তালরস আহরণে মনোযোগ দিচ্ছেন। শীতকালীন খেজুরগাছের বিকল্প হিসেবে তালগাছ যে কতটা সম্ভাবনাময়, তা তারা নিজেরাই প্রমাণ করছেন।

স্থানীয় হাটে গেলে দেখা যায়, রাস্তার পাশে হাঁড়িভরা রস বিক্রি করছেন গাছিরা। অনেকেই থেমে থেমে খাচ্ছেন ঠাণ্ডা কাঁচা রস, কেউ কিনে নিচ্ছেন পাটালী ও গুড়। তালরস থেকে তৈরি পণ্যগুলোর মধ্যে তালমিছরি এখন বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে রয়েছে প্রাকৃতিক ঔষধি গুণাগুণ-কাশি, সর্দি ও ঠাণ্ডা জনিত অসুখে এটি বেশ কার্যকর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, খেজুরগাছের তুলনায় তালগাছ থেকে রস আহরণ প্রায় তিন গুণ বেশি লাভজনক। পরিকল্পিতভাবে এই উদ্যোগকে সম্প্রসারিত করলে তালগাছ ভিত্তিক শিল্প হতে পারে গ্রামীণ অর্থনীতির একটি টেকসই মডেল।

তালগাছ কেবল আয়ের উৎস নয়, এটি পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বজ্রপাত প্রতিরোধে তালগাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক এলাকায় এই কারণে তালগাছ রোপণের হারও বাড়ছে।

তাল দিয়ে তৈরি পিঠা, পায়েস, মোয়া, শাঁকসাবুদান এখন শুধু পারিবারিক রীতি নয়, রীতিমতো অর্থনৈতিক পণ্য। অনেক নারী উদ্যোক্তা তালজাত খাদ্যপণ্য তৈরি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছেন, অনেকে অনলাইনে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও চালু করেছেন।

গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে এখন আর শুধু কৃষিজমির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। প্রকৃতির বদান্যতা আর সৃজনশীল চিন্তা একত্র হয়ে যে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে, তার উজ্জ্বল উদাহরণ কালীগঞ্জের তালগাছ। তালগাছের রস এখন শুধুই স্বস্তির নয়, এটি হয়ে উঠেছে নতুন সম্ভাবনার দীপ্ত আলো।

ইত্তেফাক/এএইচপি