বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ: কোথায় দাঁড়িয়ে আছে দুই পরাশক্তির সংঘাত

আপডেট : ০৯ মে ২০২৫, ১২:১৭

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কর্মকর্তারা এ সপ্তাহান্তে জেনেভায় প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসতে চলেছেন। উদ্দেশ্য—একটি দীর্ঘমেয়াদি পাল্টাপাল্টি শুল্কযুদ্ধ নিরসনের পথ খোঁজা, যা শত শত বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং বৈশ্বিক বাজার ও সরবরাহ শৃঙ্খলকে অস্থির করে তুলেছে।

বেইজিং থেকে এএফপি বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে চলমান এ সংঘাতের বর্তমান অবস্থা এক নজরে তুলে ধরেছে।

দুই দেশ এখন পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?

যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশে নিয়ে গেছে; কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে মোট শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ২৪৫ শতাংশে। এই সার্বিক শুল্ক ছাড়াও চীনকে লক্ষ্য করে খাতভিত্তিক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে—যেমন ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ি আমদানির ওপর।

চীনের শুল্ক পরিসংখ্যান অনুসারে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের রপ্তানি হয়েছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা দেশটির মোট রপ্তানির ১৬.৪ শতাংশ।

বেইজিং ঘোষণা করেছে, তারা ‘শেষ পর্যন্ত’ এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়বে এবং পাল্টা জবাবে আমেরিকান পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর চীনে মার্কিন রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৪৩.৫ বিলিয়ন ডলার।

চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) ‘চাপ প্রয়োগের’ অভিযোগ এনে একাধিক অভিযোগ দায়ের করেছে।

এছাড়া চীন মার্কিন কোম্পানিগুলোর ওপর পাল্টা পদক্ষেপও নিয়েছে—বোইংয়ের অর্ডার বাতিল, গুগলের বিরুদ্ধে ‘একচেটিয়া আচরণ’ তদন্ত শুরু, এবং ফ্যাশন গ্রুপ পিভিএইচ কর্প (যার মালিক টমি হিলফিগার ও কেলভিন ক্লেইন) ও বায়োটেক জায়ান্ট ইলুমিনাকে ‘অবিশ্বস্ত সত্তা’র তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে।

চীন বিরল খনিজ উপাদান—যা আধা-পরিবাহী, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স তৈরিতে অত্যাবশ্যক—তাদের রপ্তানিতেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।

এর প্রভাব কী পড়েছে?

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ২৯৫.৪ বিলিয়ন ডলার, যা দীর্ঘদিন ধরে ট্রাম্পের ক্ষোভের কারণ। চীনা নেতৃত্ব এতদিন ধরে এই স্থিতাবস্থাকে বিঘ্নিত করতে চায়নি।

তবে বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হলে চীন ২০২৫ সালের প্রবৃদ্ধির আশা আর রপ্তানির ওপর নির্ভর করতে পারবে না—যা ২০২৪ সালে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক চীনের কোভিড-পরবর্তী নড়বড়ে অর্থনীতি, সম্পত্তিখাতের ঋণসঙ্কট ও দুর্বল ভোগব্যয়ের ওপর আরও চাপ তৈরি করছে।

বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেও পড়ছে। গত মাসে শিল্পখাতে ধস নেমেছে, আর কর্মকর্তারা প্রথম প্রান্তিকে আকস্মিক অর্থনৈতিক সংকোচনের জন্য এই শুল্কযুদ্ধকেই দায়ী করছেন। 

রাবোব্যাঙ্কের সিনিয়র চীন অর্থনীতিবিদ টিওয়ে মেভিসেন এএফপিকে বলেন, ‘দুই দেশই এখন বুঝে গেছে—সম্পূর্ণভাবে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সহজ নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান বাণিজ্যযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ এমনকি যদি কোনো একটি পক্ষ কৌশলগত সুবিধাও পায়, ‘তবুও তারা যুদ্ধ-পূর্ব অবস্থার তুলনায় খারাপ অবস্থায় থাকবে।’

এপ্রিল মাসে ডব্লিউটিও প্রধান সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন সংঘাতের ফলে দেশদুটির মধ্যে পণ্য বাণিজ্য ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। চীন বুধবার সুদের হার একাধিকবার কমিয়েছে—জনভোগ বাড়াতে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি একটি বড় সংকেত যে দেশটি শুল্কযুদ্ধের ধাক্কা টের পাচ্ছে।

বিশ্লেষকদের ধারণা, এই শুল্ক চীনের জিডিপি থেকে বড় অংশ কেটে নিতে পারে। অথচ এই বছর চীনা নেতৃত্ব ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে চীনের প্রধান রপ্তানি—যেমন ইলেকট্রনিক্স, যন্ত্রপাতি, টেক্সটাইল ও পোশাক—এই ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন শিল্প ও ভোক্তারা নির্ভরশীল হওয়ায়, এই শুল্ক উল্টো আমেরিকান নির্মাতা ও ভোক্তাদেরও আঘাত করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

কোনো অগ্রগতি সম্ভব?

উভয় দেশই দাবি করছে, অর্থনৈতিক চাপ একে অপরকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে। যদিও বাজার এই আলোচনাকে স্বাগত জানিয়েছে, তবুও জেনেভায় বড় কোনো অগ্রগতি খুব একটা সম্ভাবনাময় নয়।

চীন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রকে আগে শুল্ক তুলে নিতে হবে—তাদের অবস্থান ‘অপরিবর্তিত’—এবং তারা তাদের স্বার্থ রক্ষায় ‘প্রতিজ্ঞাবদ্ধ’ থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেছেন, এই বৈঠকের লক্ষ্য হবে ‘উত্তেজনা প্রশমন’, কোনো ‘বড় বাণিজ্যচুক্তি’ নয়।

তবে বিশ্লেষকরা আশা করছেন, শনিবারের প্রাথমিক আলোচনা শেষে কিছু শুল্ক কমানোর ঘোষণা আসতে পারে।

জার্মান মার্শাল ফান্ডের ইন্দো-প্যাসিফিক প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বনি গ্লাসার এএফপিকে বলেন, ‘সুইজারল্যান্ড আলোচনার একটি সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে এ বছর আরোপিত অধিকাংশ (বা সব) শুল্ক সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা।’

এশিয়া সোসাইটির লিজি লি বলেন, তিনি আশা করছেন ‘একটি প্রাথমিক, প্রতীকী পদক্ষেপ—যার উদ্দেশ্য উত্তেজনা কমানো, মূল দ্বন্দ্বের সমাধান নয়।’ তিনি বলেন, ‘স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো স্থাপনই সম্ভবত সবচেয়ে প্রত্যাশিত ফল।’

ইত্তেফাক/এসআর