বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

শেওড়াপাড়ায় দুই বোন খুন : সিসি ক্যামেরায় অজ্ঞাত যুবক, নথিপত্র গায়েব

আপডেট : ১০ মে ২০২৫, ২৩:৩৯

রাজধানীর মিরপুরে শেওড়াপাড়ায় বাসায় ঢুকে দুই বোনকে হত্যার ঘটনায় এক যুবককে সন্দেহ করছে পুলিশ। এ ঘটনায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় এক যুবকের ছবি পাওয়া গেছে।

পুলিশ বলছে, ভিডিও ফুটেজের ছবি অস্পষ্ট থাকায় পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে না। ভিডিওতে দেখা গেছে, জিন্স প্যান্ট ও মুখে মাস্ক পরিহিত এক যুবক ওই বাসায় প্রবেশ করেন। দীর্ঘ সময় পর তিনি নিচে নেমে আসেন। নিজে চাবি দিয়ে তালা খুলে তিনি ভবন ত্যাগ করেন। তবে প্রবেশের সময় জিন্স প্যান্টের সঙ্গে যে জামা পরা ছিল, বের হওয়ার সময় ভিন্ন জামা পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে। এসময় তার মাথায় একটি ক্যাপ ছিল। ক্যাপ এমনভাবে পরা যাতে তার মুখ দেখা না যায়।

পুলিশ ধারণা করছে, ভিডিও ফুটেজে দেখতে পাওয়া ওই যুবক খুনে অংশ নিয়েছিলেন। তবে সেটি নিশ্চিত হতে ওই ভবন থেকে বের হওয়ার পর আশেপাশের ভবনের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। গতকাল পুলিশ শেওড়া পাড়ার ওই বাড়ির আশেপাশের কয়েকটি বাড়ির সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। 

স্বজনরা জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও তাদের শরীরে থাকা স্বর্ণালংকার ও আলমারিতে থাকা নগদ অর্থ খোয়া যায় নি। তবে আলমারিতে থাকা একটি ফাইলের নথিপত্র নেই। ফাইলের ওপর রক্তের রক্তের দাগ রয়েছে। তারা ধারণা করছেন, ওই ফাইলের জন্যই পূর্বপরিকল্পিভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হতে পারে। 

শুক্রবার রাতে পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামীম সরণীর ৬৪৯ নম্বর ছয় তলা বাড়ি নার্গিস ভিলার দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাট থেকে দুই নারীর রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তারা হলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অবসরপ্রাপ্ত সহকারী সমন্বয় কর্মকর্তা মরিয়ম বেগম ও তার ছোট বোন সুফিয়া বেগম। তাদের শরীরে ধারালো অস্ত্র ও ভারী কোনো বস্তুর আঘাতের চিহ্ন ছিল। তারা যে ভবনে থাকতেন সেটির মালিক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহানের বাবা। বাড়িটি সচিব বাড়ি নামে এলাকার লোকজন চিনেন। ঘটনাস্থল থেকে কিছুই খোয়া যায়নি।

ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাকছুদের রহমান বলেন, এখনো হত্যাকান্ডের কারণ ও জড়িতদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি। পারিবারিক দ্বন্দ, আর্থিক লেনদেনসহ আরো বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতদের আসামি করে মিরপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।

যেভাবে হত্যা করা হয় :
নুসরাত জাহান বলেন, হয়তো পরিচিত কেউ সকালে বাসায় এসেছিল। অন্যথায় বাসার ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেত না। বাসায় কোরবানির জন্য ছোট একটি রাম-দা ছিল। এটি মায়ের (মরিয়ম) বিছানার তোষকের নিচে থাকতো। খুনি সেই রাম-দা দিয়ে মাকে আঘাত করেছে। এতে তার ভুড়ির অংশ বের হয়ে আসে। এছাড়াও মা ও খালাকে রান্নাঘরের শিল দিয়ে আঘাত করে গুরুতরভাবে জখম করে।

বাড়ির মালিকের স্ত্রী ও সচিব নাসরিন জাহানের মা মালেকা বেগম বলেন,  দোতলায় বি-১ ফ্যাটে ভাড়া থাকতেন মরিয়ম বেগম ও তার মেয়ে নুসরাত জাহান। প্রায় ২০ বছর থেকে তারা ভাড়া থাকছেন। গত রোজার ঈদে মরিয়ম বেগমের মা মারা যান। এরপর প্রায় ২ মাস থেকে তার ছোট বোন সুফিয়া বেগম তাদের সঙ্গেই থাকতেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। 

পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া মাজেদুল ইসলাম বলেন, মরিয়ম বেগমের স্বামী কাজী আলাউদ্দিন বন বিভাগ থেকে অবসর নেন ২০১৯ সালে। চাকরি জীবনের শুরুর দিকে তার অনেক শত্রু ছিল। একবার তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তবে স¤প্রতি তার সঙ্গে কারো কোনো বিবাদ দেখা যায়নি। তিনি বরিশালের বাবুগঞ্জে স্থায়ীভাবে থাকতেন। শুনেছি তিনি সেখানে বাড়ি করেছেন, এ ছাড়া নিজস্ব গরুর খামার, চাষাবাদ ব্যবস্থা ছাড়াও বেশ কিছু ব্যবসা ছিল। দুই এক মাস পর পর তিনি এখানে আসতেন। মরিয়াম বেগমও বেশ কিছুদিন পরপর বরিশাল স্বামীর কাছে যেতেন। 

নিহত দুজনের ভগ্নিপতি বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা শাহা কামাল খান জানান, মরিয়ম বেগমের স্বামী বন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত রেঞ্জার কাজী আলাউদ্দিন ঘটনার সময় বরিশালে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। বাসায় ছিলেন শুধু দুই বোন। সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যান মরিয়মের মেয়ে কম্পিউটার প্রকৌশলী নুসরাত জাহান মিষ্টি। রাত পৌনে ৯টার দিকে তিনি বাসায় ফিরে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ পান। ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে বিকল্প চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখেন, খাবার ঘরের মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন তার মা। পাশের ঘরের মেঝেতে খালার লাশ পড়ে আছে।

যুবককে ঘিরে রহস্য:  
তদন্তসূত্র বলছে, শুক্রবার দুপুরে সন্দেহভাজন এক যুবক ওই বাসায় ঢোকেন। এক ঘণ্টার বেশি সেখানে অবস্থানের পর তিনি বেরিয়ে যান। ধারণা করা হচ্ছে, পরিকল্পনা করেই তিনি আসেন। যাওয়ার সময় দরজা তালাবদ্ধ করে যান। আবার নির্বিঘ্নে তিনি ওই বাসায় ঢোকেন। পরিবারটির পরিচিত না হলে সেটা সম্ভব ছিল না। 

মরিয়মের ছোট মেয়ে নুসরাত জাহান আরো বলেন, তিনি ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ান একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কারও সঙ্গে তার বা পরিবারের সদস্যদের কোনো বিরোধ নেই। তাই কে বা কারা কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তিনি ধারণা করতে পারছেন না। 

বাড়ির মালিকের স্ত্রী ও সচিব নাসরিন জাহানের মা মালেকা বেগম বলেন,  দোতলায় বি-১ ফ্যাটে ভাড়া থাকতেন মরিয়ম বেগম ও তার মেয়ে নুসরাত জাহান। প্রায় ২০ বছর থেকে তারা ভাড়া থাকছেন। গত রোজার ঈদে মরিয়ম বেগমের মা মারা যান। এরপর প্রায় ২ মাস থেকে তার ছোট বোন সুফিয়া বেগম তাদের সঙ্গেই থাকতেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। 
বাড়িয়ালার বাসার গৃহকর্মী আছিয়া বেগম জানান, দুপুর দেড়টার দিকে কাজ শেষ করে নিচে নামার সময় বি-১ ফ্ল্যাট থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পাই। দারোয়ানকে বিষয়টি জানাতে দৌড়ে নিচে যাই। সেখানে তাকে দেখতে না পেয়ে মূল দরজায় তালা লাগিয়ে দেই। তবে ওপরে আসার পর থেকে ওই ফ্ল্যাটে আর কোনো শব্দ পাইনি। 

ঘটনাটি তদন্ত করতে পুলিশের পাশাপাশি মাঠে কাজ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পিবিআই। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, খুনি বা খুনীরা বাড়ির ভেতরে থাকা সিসি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক নিয়ে গেছে। তবে বাড়িটির বাইরে একাধিক সিসি ক্যামেরা আছে। সেগুলোর ফুটেজ নিয়ে খুনিকে শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

পুলিশের মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। তবে কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড তা এখনও জানা যায়নি। ফলে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিরোধসহ সম্ভাব্য সবগুলো কারণ ধরেই তদন্ত করা হচ্ছে।

ইত্তেফাক/এমএএম