বিষাক্ত পানির কারণে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ইলিশের প্রজনন কেন্দ্রখ্যাত ষাটনলের মেঘনায় ব্যাপকহারে মাছ মরে ভেসে উঠছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এমন নির্দিষ্ট একটি ছবি দিয়ে শুক্র ও শনিবার এমন সংবাদ প্রচার হয়। এই সংবাদ নিয়ে মারাত্মক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
শুক্রবার (১৬ মে) রাত সাড়ে ১০টায় উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাশের এমন তথ্যের ভিত্তিতে পরের দিন ১৭ মে শনিবার ১৮ মে রবিবার নদীর জোয়ার ও ভাটা উভয় সময়ে দেখার জন্য সকাল ৯ টা থেকে বেলা ৩ টা পর্যন্ত (৭ ঘণ্টা) উপজেলার ষাটনল থেকে আমিরাবাদ পর্যন্ত মেঘনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটার নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ঘুরে দেখেন ইত্তেফাকের প্রতিবেদক।
ষাটনল নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে ষাটনল মালোপাড়া, ছটাকি, শিকিরচর, দশানী, মোহনপুর, নয়ানগড়, হাশিমপুর বকুলতলা, এখলাছপুর, জয়পুর হয়ে আমিরাবাদ বাজার পর্যন্ত নদীর তীরবর্তী ২৫ কিলোমিটার অঞ্চল ঘুরে কোথাও অল্প বা বেশী মাছ মরে থাকার কোন দৃশ্য বা আলামত দেখা যায়নি। পানি বিষাক্তের কারণে মেঘনা নদীতে মাছ মরে গেলে বিগত সময় দেখা গেছে মাছ মরার রেশ বেশ কয়েকদিন থাকে। গত দু'দিনে এমন আলামত তো দেখা যায়নি, এমনকি স্থানীয়দের নদীর এই পানিতে গোসল ও পানি বিভিন্ন কাজে নেওয়ার দৃশ্যও দেখা গেছে।
অথচ, শনিবার মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে শুধু চেওয়া মাছ মরেছে নাকি অন্য মাছও মরেছে এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাশের দাবি- লাল চেউয়া, সাদা চেউয়া, বেলে, সেলেং, চিংড়ি সহ বিভিন্ন মাছ মরে ভেসে আছে। অথচ ঠিক সেই সময় তিনি ছিলেন ভারতের চেন্নাইতে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় গত বৃহস্পতিবার (১৫ মে) তিনি ভারতের চেন্নাই শহরে যান। অথচ, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ওনার এই তথ্য সরবরাহ ও বক্তব্যের কারণে ‘পানি বিষাক্ত হয়ে যাওয়ায় মতলবের মেঘনা নদীতে আবারও মাছ মারা যাচ্ছে। দুর্গন্ধে থাকা যাচ্ছে না।’ এমন খবর ছইয়ে পড়ে। যদিও সরেজমিনে এর আলামত বিন্দু মাত্রও দেখা যায়নি।
উপজেলার সর্বাধিক জেলেদের বসবাসের অঞ্চল ষাটনল মালোপাড়া এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার ফুলচান বর্মণ জানান, গত কয়েকদিন নদীতে মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা না ঘটলেও গত জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের দিকে প্রায়ই নদীতে মাছ মরার ঘটনা ঘটছে।
উপজেলা মৎস্য অফিসে হিসাবরক্ষক ও একজন পিয়ন ছাড়া বাকি পদ শূন্য রয়েছে। সেই পিয়ন ও হিসাবরক্ষকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তারা গত কয়েক দিনের মধ্যেই মেঘনা নদীর পাড়ে আসেননি বলে জানান।
মতলব উত্তর উপজেলার অতিরিক্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে চাঁদপুর সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মির্জা ওমর ফারুক জানান, আমি কয়েকটি পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে মতলব উত্তরের মেঘনা নদীতে ব্যাপক হারে মাছ মারা যাচ্ছে। ব্যস্ততার কারণে আমি এখনো মতলব উত্তরে যেতে পারিনি এমনকি মতলব উত্তরের কোন কেউ আমাকে কিছু জানায়নি। এমনকি রোববার (১৮ মে) তেও মৎস্য বিভাগ বা পরিবেশ অধিদপ্তরে কেউ মতলবের মেঘনা অঞ্চলে আসেননি।
তবে ইলিশের প্রজনন কেন্দ্র এই ষাটনল থেকে আমিরাবাদ বাজার পর্যন্ত মতলবের এই ২৫ কিলোমিটার অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এত সত্বেও মৎস্য বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল এতটাই অরক্ষিত দেখে উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মতিউর রহমান চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মৎস্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল এতটা অরক্ষিত দেখে সত্যিই আমি হতাশ। অথচ শুনেছি, প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে এই অঞ্চল তদারকির জন্য দুটি টীম থাকার কথা। অথচ কিছুই দেখতে পাচ্ছি না
ইলিশের প্রজনন কেন্দ্র ষাটনল থেকে আমিরাবাদ পর্যন্ত মতলব উত্তরের এই ২৫ কিলোমিটার অঞ্চলে মেঘনা নদীর পানি দূষিত হয়ে যাওয়ার কারণে গত কয়েক বছর যাবত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাছ মরার ঘটনা ঘটছে। একাধিকবার তদন্ত কমিটি গঠন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন, আলামত সংগ্রহ ও ল্যাবরেটরির পরীক্ষা, সে অনুযায়ী করনীয় নির্ধারণ সবই হয়েছে কিন্তু কোন কিছুরই হয়নি বাস্তবায়ন। এমনকি ২০২৩ সালে চারটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আন্ত মন্ত্রণালয়ের সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত হলেও তারও কোন বাস্তবায়ন হয়নি।
মেঘনায় অবাধে মাছের মৃত্যু ঠেকাতে ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট বাংলাদেশ সচিবালয়ের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরেরই ৩০ আগস্ট উপসচিব মো. আব্দুর রহমান স্বাক্ষরিত ডকুমেন্ট থেকে এরকম সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু অদ্যবধি এর কোন বাস্তবায়ন নেই।
এ বছরের ৩০ জানুয়ারি সর্বশেষ তদন্ত কমিটি মতলবের মেঘনাঞ্চলে আসলে ওই তদন্ত কমিটির প্রধান পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মো. সোহরাব আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক'কে জানান, নদীর পাড়ের নিকটস্থ শিল্প কারখানার বর্জ্যই এখানকার পানি দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ।
তবে মেঘনার সবচাইতে বেশি জেলের বসবাস সেই ষাটনল মালোপাড়া অঞ্চলের কয়েকজন জনের সঙ্গে তথা হলে তারা জানান, গত কয়েকদিন নদীর পারে মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা না ঘটলেও বিষাক্ত পানির কারণে নদীর পাড়ে মাছ মারা জাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তবে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে।
ভারতে থেকেও মুঠোফোনে শনিবার (১৭ মে) মতলব উত্তর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, এটি নিছক মাছ মরার ঘটনা নয়, এটি একটি জলজ পরিবেশগত দুর্যোগ। শীতলক্ষ্যা থেকে আসা দূষিত পানির প্রবাহ একাধিকবার এই এলাকায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এটি প্রথম নয়, একাধিকবার ঘটেছে এমন ঘটনা। ২০২৩ সালের মার্চ ও ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেও একই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল। তখনও মেঘনার পানি দূষিত হয়ে মাছের গণমৃত্যু হয়। তবে এবার পরিমাণ আরও বেশি দেখা যাচ্ছে।
সরেজমিনে না আসলেও পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, মেঘনা নদীতে মাছ মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। সেখানকার প্রতিবেদন অনুযায়ী নদীর পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, পিএইচ ও অক্সিজেনের হার কমে গিয়েছিল। এ ছাড়া নদীর তলদেশ দিয়ে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত পানি বয়ে যাচ্ছে।