জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে সরাসরি গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। মামলার তদন্ত বা বিচারের যে কোন পর্যায়ে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের এই ক্ষমতা দিয়ে কার্যপ্রণালী বিধিমালা সংশোধন করেছে ট্রাইব্যুনাল।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল বুধবার এই বিধিমালা জারি করে, যা বৃহস্পতিবার গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন: বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও জজ এম মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
১৯৭৩ সালে প্রণীত ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্টের’ ২২ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কার্যপ্রণালী বিধিমালা-২০১০ সংশোধন করে এই বিধিমালা জারি করেছে ট্রাইব্যুনাল। বিধিমালার ২৫টি ধারা, ফর্ম, মনোগ্রাম ও সিলসহ মোট ৪৪টি সংশোধনী আনা হয়েছে।
সংশোধিত বিধিমালা অনুসারে, ট্রাইব্যুনাল কোনো আসামি বা আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটরও পরোয়ানাভুক্ত আসামি বা আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারবেন।
সংশোধিত ৩৪ এর ১ ধারায় বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা তদন্তকারী কর্মকর্তা অথবা তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্বে নিযুক্ত থাকা প্রসিকিউটর আসামিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্রাইব্যুনালে অথবা কোনো বিচারিক হাকিম বা মহানগর হাকিমের সামনে হাজির করবেন।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগের বিধি অনুযায়ী অভিযুক্ত, সন্দেভাজন ব্যক্তিকে তদন্তকারী কর্মকর্তা গ্রেপ্তার করতে পারতেন না। কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হতো। ট্রাইব্যুনাল সেই আবেদন মঞ্জুর করে পরোয়ানা জারি করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তার করতে হতো। এখন তা করতে হবে না।’
‘ট্রাইব্যুনালের পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহভাজন অভিযুক্তকে তদন্তকারী কর্মকর্তা গ্রেপ্তার করতে পারবেন। পাশাপাশি পরোয়ানাভুক্ত আসামিকে এখন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি তদন্ত সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটরও গ্রেপ্তার করতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘আগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবর প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় অনেক অভিযুক্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। এখন সরাসরি গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়ায় আসামি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।’
সংশোধিত বিধিমালায় প্রধান প্রসিকিউটরের এখতিয়ার বৃদ্ধি করেছে ট্রাইব্যুনাল। বিধিমালার ১৮ (১এ) ধারায় বলা হয়েছে, কারো বিরুদ্ধে কোনো অনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে তা নির্ধারণ করবেন প্রধান প্রসিকিউটর। এখতিয়ার অনুযায়ী তিনি পরিপত্র জারি করে ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনো মামলা বিচারের জন্য নিম্ন আদালতে পাঠাতে পারবেন। এমনকি আসামির সংখ্যা বেশি হলে মামলায় একাধিক আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে আসামির সংখ্যা ভাগ করে দিতে পারবেন।
বিধিমালায় রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের বিচার কীভাবে হবে সেই পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে। সংশোধিত ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি হেফাজতে না থাকলে ট্রাইব্যুনাল একটি তারিখ ধার্য করে সমন অথবা পরোয়ানা পাঠাতে পারবে। কোনো সংগঠনের ক্ষেত্রে অভিযোগ আমলে নেওয়া হলে এর সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের কাছে সমন পাঠাতে হবে।
এছাড়া তদন্ত সংস্থার কোন সদস্য কোনো আবেদন দিলে যে কোন বিচারিক হাকিম সাক্ষীর জবানবন্দি নথিবদ্ধ করতে বাধ্য থাকবেন। সংশোধিত বিধিমালার ১৮ (১সি) ধারায় বলা হয়েছে, এই ট্রাইব্যুনাল বিচারের জন্য সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া বাংলাদেশের যে কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে নথিপত্র চাইতে পারবে। বিধিমালায় ইংরেজিতে পুরুষবাচক সর্বনামের পাশাপাশি স্ত্রীবাচক সর্বনাম সংযোজন করা হয়েছে।
সংশোধনীর বিবিধ অংশে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালী বিধিমালা এবং আইসিটি বিডি ফর্মগুলোতে ইংরেজি ‘হি’ শব্দটি ‘হি অথবা শি’, হিম শব্দটি ‘হি অথবা হার’, হিজ শব্দটি ‘হিজ অথবা হার’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।’
বিধিমালার ২২, ২৩ ধারা ও ৬৩ (এ) উপধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ তিনটি ধারা ও উপধারা সংশোধন বা অন্য কোনো শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়নি। গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অক্টোবরে আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে গঠিত এ ট্রাইব্যুনালে পরিবর্তন আসে।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুবনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমন পীড়নকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে এ আদালতে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।