শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

‘বর্ষা মৌসুমোত হামারগুলার খুব কষ্ট বাহে’

আপডেট : ১২ জুন ২০২৫, ২১:৪৫

কি কমো বাহে! বর্ষা মৌসুমে ধরলা-বারোমাসিয়া নদীত পানি বাড়তিছে, হামার দু:খের শ্যাষ নাই। না হলেও ২০/২৫ দিন থেকে হামারগুলার কষ্টে দিন শুরু হছে। হামার গুলার দু:খ আর কায় দেখে বাহে! কেউ যদি অ্যানা বাঁশের সাঁকো বানেয়া দিলে হামারগুলার খুব উপকার হলো হয় বাহে!

এক বুক কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের চর-সোনাইকাজী গ্রামের ১০৩ বছর বয়সী বৃদ্ধ অরিচ মিয়া।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকার অরিচ মিয়াসহ প্রায় ৮০ টি পরিবার দুর্গম চরে বসবাস করেন। চর সোনাইকাজী এলাকায় অনেকের সাথে কথা হলে তারা জানান, বর্ষাকাল এলেই তাদের কষ্ট বেড়ে যায়। জরুরী প্রয়োজনে চর থেকে বেড় হলেই ছোট ডিঙি নৌকায় তাদের একমাত্র ভরসা।  

ওই এলাকার বাসিন্দা ছয়ফুল ইসলাম, বাছের আলী ও মর্জিনা বেগম জানান, এখন পানি কম থাকায় মাত্র পাঁচ টাকার বিনিময়ে আমরা নদী পাড় হই। এই চরে ৭০ থেকে ৮০ টি পরিবার বসবাস করেন। এরমধ্যে দুই থেকে তিন জনের নিজস্ব ডিঙি নৌকা আছে। আর বাকি পরিবারগুলোর কারোই নিজস্ব ডিঙি নৌকা নেই। তারা সবাই বারোমাসিয়া নদী পাড় হন ছোট ডিঙি নৌকায় করে। নদীর পাড়ের জন্য আমাদের পাঁচ টাকা করে দিতে হয় নৌকার মালিককে (মাঝি)। 

এই তিন বাসিন্দা আরও জানান, এখন প্রতিদিনেই কম বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। একদিকে বৃষ্টিপাত আর অন্য দিকে উজানের ঢলে ধরলা ও বারোমাসিয়া নদীর পানি বেড়েই চলেছে। বন্যার সময় এই চরের প্রতিটি পরিবারের ঘর-বাড়িতে পানি উঠে। ওই সময়টা প্রায় এক দেড় মাস আমাদের কষ্টটা অনেক বেশি। চরে এতো কষ্ট করে থাকেন কেন এমন প্রশ্ন করে তারা জানান, শুকনো মৌসুমে চরে বোরো, ভুট্টা, বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ করে কোন রকম জীবন জীবিকা নির্বাহ করি। যাদের নিজস্ব জমি নেই তারাও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কোন রকম খেয়ে না খেয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিছু কিছু পরিবার আছে তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কষ্ট হলেও পরিবার-পরিজন নিয়ে চরেই বসবাস করছেন। মর্জিনা বেগম জানান বন্যার সময় পুরুষদের তুলনায় নারীদের কষ্টটা অনেক বেশি। নারী শিশু বাচ্চাদের সব সময় নজরে রাখেন। সেই সাথে রান্নাসহ নানা বিষয়ে নারীদের জন্য এক অসহনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয় আমাদের। 

চরে বসবাসরত শিক্ষার্থী লাবন মিয়া ও আঁখি আক্তার জানান, এখন আমাদের স্কুল বন্ধ। পারাপারের ভোগান্তি কম। যখন স্কুল খুলবে তখন আমাদের খুবই সমস্যা দেখা দেয়। এমনিতে আমাদের চরে নেই বিদ্যুৎ অবস্থা। কুপির আলোয় পড়াশুনা করি। সরকার ও বা জনপ্রতিনিধি যদি অন্তত নদী পারাপারের জন্য একটি বাঁশের সাকোর ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে আমাদের অনেকটা দু:খ দুর্দশা কমতো। 

স্থানীয় জোবেদ আলী (৭২) জানান, আসলেও চর-সোনাইকাজী গ্রামের নদী ওপারের পরিবারগুলো বছরের পর বছর কষ্ট সহ্য করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তাদের চারিদিকে নদী। অনেক কষ্টে পরিবার নিয়ে তারা সেখানে বসবাস করছেন। ওই পরিবারগুলো সারা বছর কষ্ট করছে। শুকনো মৌসুমে বারোমাসিয়া নদীটিতে হাঁটু পানি দিয়ে চলাচল করতে হয়। এখন পানি বেড়ে যাওয়ায় ডিঙি নৌকায় পারাপার করছেন। তিনি বারোমাসি নদীতে একটি সাঁকোর ব্যবস্থা করলে তাদের কষ্ট অনেকাংশে কমতো। 

বারোমাসিয়া নদীর পাড়ের নৌকার মাঝি তৈয়ব আলী (৭০) জানান, এই চরে প্রায় ৮০ টি পরিবার বসবাস করছে। তারা মূলত সারা বছরেই পানির সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছে। শুকনো মৌসুমে বাড়ি ঘরে পানি থাকলেও বারোমাসি নদীতে হাটু পানি দিয়ে চলাচল করতে হয়। এখন বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। সমস্ত নদ-নদীতে পানি বেড়েছে। এখন ওই পারের মানুষজন দৈনন্দিন উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে বের হলেই নৌকা দিয়ে পারাপার করতে হয়। এখানে বড় নৌকা নেই। আমার ছোট একটি ডিঙি নৌকায় এখন তাদের পারাপারের কাজে ব্যবহার করছি। সবাই পরিচিত কেউ পাঁচ টাকা দেন, কেউ আবার এক টাকাও দেন না৷ তারপরও তাদের পারাপার করছি। তবে সারাদিনে দেড় থেকে ২০০ টাকা আয় হয়। তিনিও সেখানে একটি বাঁশের সাকোর দাবি জানিয়েছেন। 

চর সোনাইকাজী ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, দীপ চরে তার ওয়ার্ডে ৬০ থেকে ৬৫ টি পরিবার বসবাস করেন। চর জ্যোতিন্দ্র নারায়ণ গ্রামের ১৫ থেকে ২০ টি পরিবার ও চরে বসবাস করেন। দুই গ্রামের প্রায় ৮০ টি পরিবার ধুধু বালু চরে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। তাদের সবাই বর্ষাকালে অনেক কষ্ট করে সেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। অবশ্য তাদের যাতায়াতের জন্য একটা সাকো নির্মাণ করাও খুবই জরুরী। আমরা বন্যা আসলেও চরের প্রতিটি পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হয়। 

শিমুলবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শরিফুল ইসলাম মিয়া সোহেল জানান, আসলেই চর সোনাইকাজী ও জ্যোতিন্দ্র নারায়ণের অল্প কিছু অংশসহ ওই দুর্গম চড়ে প্রায় ৮০টি পরিবার যুগের পর যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। তাদের চারিদিকে নদী। বর্ষা মৌসুমে বাড়ি-ঘর পানিসহ তাদের চারিদিকে যেন মহা সমুদ্রে পরিণত হয়। মূলত তারা ৬ মাস তারা সীমাহীন কষ্টে থাকেন। নেই বিদ্যুৎ অবস্থা। তারপরও তারা বেঁচে থাকার তাগিদে ওই সব দুর্গম চরে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। বর্ষাকালে সেখানকার পরিবারগুলোকে সরকারি সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়। তবে একটা বাঁশের সাকোর ব্যবস্থা করা হলে তাদের অনেকটা দুর্ভোগ কমবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে বলে জানান তিনি।

ইত্তেফাক/এএইচপি