বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

চাকরি স্থায়ীকরণ ও বকেয়া বেতনের দাবিতে ইআরপিপি কর্মীদের অবস্থান

আপডেট : ১৪ জুন ২০২৫, ১৪:২০

চাকরি স্থায়ীকরণ ও বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান ফটকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপারডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের আউটসোর্সিং কর্মীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। প্রয়োজনে আরও কঠোর আন্দোলনেরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

শনিবার (১৪ জুন) সকাল ১১টা থেকে রাজধানীর মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান ফটকে কর্মসূচি শুরু করেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ১০০৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী। 

তাদের দাবি, মহামারির সময় ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিলেও এখন তারা অবহেলার শিকার হচ্ছেন। তারা বলছেন, নতুন করে দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, এ অবস্থায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত এই জনবলকে কাজে না লাগালে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।

আন্দোলনরত এক স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, মহামারির সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা সেবা দিয়েছি, অথচ এখন আমরা অবহেলিত। 

তিনি জানান, প্রকল্প শেষে তাদের চাকরির কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। উপরন্তু, মাসের পর মাস বেতন না পেয়েও তারা স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে গেছেন। তাদের ভাষায়, আমাদের নিয়োগ হয়েছিল সরকারিভাবে, কিন্তু বাস্তবে আমাদের ব্যবহার করা হয়েছে 'চুক্তিভিত্তিক' ও 'আউটসোর্সিং' কর্মী হিসেবে। এটা সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন।

এসময় ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি সেন্টারের ডাটা অপারেটর আব্দুর রহমান বলেন, ২০২০ সালে করোনা যখন প্রথম ধাক্কা দেয়, তখন মানুষ ভয়েই ঘর থেকে বের হতো না। আমি তখন সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে পিপিই পরে ল্যাবে যেতাম। মাসের পর মাস পরিবার ছেড়ে আইসোলেশনে থেকেছি, ঈদেও বাড়ি যাইনি, শুধু যাতে দেশের মানুষ করোনা পরীক্ষার সুযোগ পায়।

এখন পাঁচ বছর পর, আমরা যখন একটু স্থায়িত্বের আশা করছিলাম—তখন বলা হচ্ছে আমাদের আর দরকার নেই। নতুন লোক আনার চেষ্টা হচ্ছে আমাদের জায়গায়। এটা কেমন বিচার? এখন আমরা না পাচ্ছি বেতন, না পাচ্ছি চাকরি। বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। কারও বাসাভাড়া বাকি, কারও সন্তানের স্কুল ফি দিতে পারছেন না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের অনেকের বয়স এমন জায়গায় চলে গেছে যে এখন সরকারি চাকরিতে আর আবেদনও করতে পারছি না। তাহলে কি আমরা দেশসেবার শাস্তি পাচ্ছি? আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সময়টা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জন্য দিয়ে, এখন অবহেলায় পড়ে আছি—এটাই কি মূল্যায়ন?

নিপসমের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আবু সুফিয়ান বলেন, আমার গ্রামের বাড়িতে সবাই গর্ব করে বলতেন, আমার ছেলে করোনার সময় সামনে থেকে যুদ্ধ করেছে। সেই সময় পিপিই, গ্লাভস, মাস্কের সংকট, বৃষ্টি, ঝড় কিছু থামাতে পারেনি আমাদের। হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে অনেকে সংক্রমিত হয়েও লুকিয়ে গেছেন যেন দায়িত্ব না হারান। অথচ আজ, পাঁচ বছর পর আমাদের বলা হচ্ছে, ‘তোমাদের আর প্রয়োজন নেই’। আমাদের কথা কেউ শুনছে না।

তিনি বলেন, সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটা হচ্ছে—আমরা শুনি, আমাদের পদে নতুন লোক নেওয়া হবে! অথচ আমাদের তো দক্ষতা, অভিজ্ঞতা আছে। তাহলে কেন আমাদের বাদ দিয়ে অদক্ষদের সুযোগ দেওয়া হবে? এটা অন্যায়। আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হলে পরবর্তী সময়ে কেউ আর সরকারের ডাকে সাড়া দিতে আগ্রহী হবে না।

জানা গেছে, ইআরপিপি প্রকল্পের আওতায় জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অ্যানেসথেসিয়া/ক্রিটিক্যাল কেয়ার) ১৬ জন, মেডিকেল অফিসার (আইসিইউ) ৮০, ল্যাব কনসালট্যান্ট ৩০, সিনিয়র স্টাফ নার্স ১৫০, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ১২৬, ডাটা অপারেটর ১৯০, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট ৫১, ওয়ার্ড বয় ১০৪, আয়া ১০৩ ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী ১৫১ জন ছিলেন। তাদের মধ্যে ২৫৯ জন রাজধানীতে, ১৫৩ জন পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে, এবং ৫৯২ জন জেলা শহরে কোভিড ও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় কর্মরত ছিলেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ধাপে ধাপে ইআরপিপি প্রকল্পে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তাদের পারিশ্রমিক পরিশোধ করা হয়। যদিও প্রকল্পের মেয়াদ ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত, তবে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তির মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়।

পরবর্তীতে ৭ জানুয়ারি ২০২৫ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত স্টিয়ারিং কমিটির ১৩তম সভায় ইআরপিপি প্রকল্পের মেয়াদ ৬ মাস বাড়িয়ে জুন ২০২৫ পর্যন্ত বর্ধিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর ভিত্তিতে কর্মীদের মৌখিকভাবে দায়িত্বে বহাল থাকতে বলা হয়। তারা জানায়, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত কাজ করলেও কোনো বেতন পাননি।

তারা অভিযোগ করেন, গত ২৫ মে হঠাৎ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও গবেষণা শাখা একটি চিঠি দিয়ে তাদের দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। এতে তারা হতবাক হন।

একইসঙ্গে, তারা আশঙ্কা করছেন—একটি প্রভাবশালী মহল ইচ্ছাকৃতভাবে এই দক্ষ জনবলকে বাদ দিয়ে নতুন অদক্ষ লোক নিয়োগ দিতে চাইছে, যার মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা চলছে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট জনবল জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু ইআরপিপির কর্মীরা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তারা নির্ধারিত সময়ে কাজ করেছেন এবং হাজিরাশিট যথাযথভাবে পাঠানো হয়েছে। এই মিথ্যা ও বানোয়াট বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছেন তারা।

প্রায় পাঁচ বছর ধরে সরকারের অর্থায়নে দক্ষ হয়ে ওঠা এই কর্মীরা বলছেন, এখন তাদের ছেঁটে ফেলার যে প্রয়াস চলছে তা শুধু অমানবিকই নয়, বরং পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র। তাদের ভাষায়, আমরা বাংলাদেশি, এই জাতি কখনও জুলুম মেনে নেয়নি, আমরাও মানব না।

এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

ইত্তেফাক/পিএস