শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

চাঁদাবাজির শুধু হাতবদল হয়েছে, মাত্রা কমেনি

অতিষ্ঠ পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা

আপডেট : ২২ জুন ২০২৫, ০৮:০০

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হয়েছে। টানা সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সমর্থক ও অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল আন্তঃজেলা ও নগর পরিবহনের বিভিন্ন রুট, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাত বদলে সেই নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে অন্য একটি চক্রের হাতে। রাজধানীর ফুলবাড়িয়া, যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি করছে প্রায় আগের মতোই। ফলে বাস মালিক ও শ্রমিকরা রীতিমতো অতিষ্ঠ।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্র থেকে জানা যায়, বিগত সরকার পতনের পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে দেখা গেছে যে স্থানীয় প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। গত ১১ ফেব্রুয়ারি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়। তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, সিটি করপোরেশন, টার্মিনাল কর্তৃপক্ষের ফি, কাউন্টার ও টার্মিনালের খরচ, শ্রমিক, লাইনম্যান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং নিরাপত্তারক্ষীদের ফি আদায়ের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। সংস্থার পক্ষ থেকে এমন ১১ ধরনের পেমেন্টের প্রমাণ পেয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত চাঁদাবাজিটা বেশি হয় পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নামে। এর অংশ আবার যায় পুলিশ প্রশাসনে। রাজধানীর চারটি আন্তঃজেলা ও অভ্যন্তরীণ রুটের টার্মিনালসহ বিভিন্ন পরিবহন কাউন্টারে চাঁদাবাজির যে চিত্র উঠে এসেছে,  তা রীতিমতো ভয়াবহ।

অনুসন্ধান বলছে—রাজধানীর সায়দাবাদ, মহাখালী, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, মিরপুর, আজিমপুর, মতিঝিল-কমলাপুর ও গাবতলী বাস টার্মিনাল এবং ভাসমান মিলে গাড়ির সংখ্যা কয়েক হাজার। এসব গাড়ি রাস্তায় নামলে দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা দিতে হয়।  চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বিশেষ করে মালিক সমিতি ও  শ্রমিক সমিতির নামে। এরপর রয়েছে হেলপার, কন্ড্রাকটর, চালককে পরিচয়পত্র দেওয়াসহ নানা অজুহাত।  সড়কে চাঁদার এমন জাল রাজধানী জুড়ে বিছিয়ে রয়েছে।

ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালের (গুলিস্তান- ফুলবাড়িয়া) একাধিক পরিবহন শ্রমিক ও শ্রমিক জানিয়েছে, টার্মিনালে কোনো বৈধ কমিটি নেই। তা সত্ত্বেও একটি চক্র মালিক নিজেদের বৈধ কমিটি দাবি করে মালিক সমিতির নামে প্রতি গাড়ি থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করছে ৭০০ টাকা, বাসের চালক, হেলপারও কন্ড্রাকটরকে পরিচয়পত্র দেওয়ার  চাঁদা নিচ্ছে ৯০০ টাকা।  এ টার্মিনাল থেকে ৩৬টি রুটে চলাচলরত দেড় হাজার  বাস থেকে চাঁদা তোলা হয়। প্রতিদিন বাসপ্রতি ৩০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া এই টার্মিনাল থেকে শ্রমিক ইউনিয়নের নামে বাসপ্রতি আলাদাভাবে তোলা হয় চাঁদা।

এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘মালিক সমিতির নামে চাঁদা আদায় বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়। এ বিষয়টি আমরা অবগত নই।’  কমিটির ব্যাপারে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কমিটি থেকে পাঁচ জন সদস্য পদত্যাগ করেন। সেই শূন্যপদে কমিটি নতুন করে পাঁচ জনকে নিয়োগ দেয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমার আগে (সাধারণ সম্পাদক) এক জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল (তার নামও ছিল কাশেম)। তিনিও কয়েক দিন আগে পদত্যাগ করেন। পরে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমান কমিটির মেয়াদ আগামী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। নতুন কমিটির নির্বাচনের জন্য পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। তবে তা ৩০০ টাকা না। কার্ডের (পরিচয়পত্র) খরচের জন্য কিছু টাকা নেওয়া হচ্ছে। চাঁদাবাজির যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’

অন্যদিকে প্রতি বাস থেকে ৭০০ টাকা চাঁদা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক  মো. সাইফুল আলম। তিনি বলেন, যারা এ তথ্য দিয়েছে তারা বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রকৃত অর্থে প্রতি বাস থেকে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা তোলা হয়। যা থেকে সিটি করপোরেশনের টোল বাবদ দিতে হয় ৬০ টাকা, শ্রমিক ফান্ডে ৩০ টাকা। এছাড়া রয়েছে আনুষঙ্গিক  কিছু খরচ। তিনি আরও বলেন, ৭০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়ার যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সে ব্যাপারে খোঁজ নেব। যদি অভিযোগ সঠিক হয় তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে  কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজির একটি ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। তারা একটা টোকেন ব্যবহার করতেন। তবে এটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ চাঁদাবাজির চিহ্ন রয়ে যেত কাগজে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই ব্যবস্থার দখল নেয় স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।

বর্তমানে রাজধানী এবং এর আশপাশের এলাকায় বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ, হিউম্যান হলার (লেগুনা) এবং অটোরিকশাসহ ৯৫ ধরনের টার্মিনাল এবং স্ট্যান্ড রয়েছে। এর মধ্যে ৬৬টি টার্মিনাল এবং স্ট্যান্ডই রয়েছে রাজধানীতে। এর মধ্যে রয়েছে ৩৭টি লেগুনা স্ট্যান্ড, সাতটি স্থানীয় বাস স্ট্যান্ড, পাঁচটি পিকআপ স্ট্যান্ড, চারটি স্থানীয় এবং আন্তঃজেলা বাস স্ট্যান্ড, চারটি অটোরিকশা স্ট্যান্ড, তিনটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, তিনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড, দুটি ট্রাক স্ট্যান্ড এবং একটি মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড।

এতে আরও বলা হয়েছে যে, দূরপাল্লার ও মাঝারি পাল্লার বাস, ট্রাক, পিকআপ এবং কাভার্ড ভ্যান, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, হিউম্যান হলার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা এমনকি রিকশা থেকেও চাঁদাবাজি করছে দুর্বৃত্তরা।

বাস মালিক ও চালকরা জানিয়েছেন, সড়কে বিশৃঙ্খলার পেছনে বড় কারণ চাঁদাবাজি।  পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় ও দুর্ঘটনারও অন্যতম কারণ চাঁদাবাজির প্রভাব। ঢাকার রাস্তায় চলতে একটি বাসকে দৈনিক গড়ে ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এই টাকা তুলতে বাসগুলোর বাড়তি ট্রিপ মারার প্রবণতায় পেয়ে বসে।

ইত্তেফাক/এমএএম