জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থা দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে চলছে ‘মার্চ টু এনবিআর’ এবং ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। এসব কর্মসূচির ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে আমদানি-রপ্তানি ও পণ্য চালানের শুল্কায়ন কার্যক্রম, ব্যাহত হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য।
শনিবার দুপুর আড়াইটায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ জানায়, রোববারও (আজ) চলবে শাটডাউন কর্মসূচি। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এই কর্মসূচির আওতার বাইরে থাকবে। আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত, তবে তার আগে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে- এই দাবিতে তারা অনড়।
এনবিআরের অচলাবস্থার প্রেক্ষিতে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক সংগঠনগুলো- বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিসিআই এবং আইসিসি বাংলাদেশ। তারা জানান, প্রতিদিনের অচলাবস্থায় দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। প্রতিদিন ২,৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে চলমান অচলাবস্থা নিরসনে আলোচনা করে এর সমাধান চেয়েছেন তারা।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, এনবিআরের অচলাবস্থায় দৈনিক আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়ছে। তুলনামূলক ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ার শঙ্কায় আছে।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, দেশের আমদানি-রফতানি ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পোর্টে, বিমানবন্দরে আমদানি ও রফতানিযোগ্য পণ্য পড়ে থাকায় বৃষ্টি-রোদে নষ্ট হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে কোনো রকম শর্ত ছাড়া আন্দোলনকারীদের কাজে যোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে সংকট কাটাতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে এগিয়ে আসার তাগিদ দেন ব্যবসায়ী নেতারা।
এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নাসিম মঞ্জুর বলেন, কোনো সমস্যা টেবিলে বসে সমাধান করা যায় না- সেটা আমরা বিশ্বাস করি না। বসতে হবে, কথা শুনতে হবে, কিছু ছাড় দিতে হবে। কিন্তু এনবিআরের সংস্কার হতে হবে। তবে দাবির প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসাররণের বিপক্ষে অবস্থানের কথা জানানো হয় যৌথ সংবাদ সম্মেলন থেকে।
এদিকে শনিবার সকাল থেকে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেবা গ্রহীতাদের এনবিআরের ভেতরে প্রবেশ করতে বা বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। আন্দোলনকারীরা মূল ফটকের সামনে বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন হাতে স্লোগান দিচ্ছেন। তীব্র রোদ উপেক্ষা করে এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ সংশোধন ও এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। এনবিআরের মূল ফটক বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে অবস্থান নিয়েছে বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা। এনবিআর ভবনের আশপাশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এনবিআরের সামনে প্রস্তুত রাখা হয়েছে পুলিশের জল কামান ও রায়ট কার।
আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, এনবিআর চেয়ারম্যান সমস্যার সমাধান না করে মিথ্যাচার করছেন। দাবি মেনে না নেওয়ায় পূর্ব ঘোষিত কমপ্লিট শাটডাউনের অংশ হিসেবে সারাদেশের কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট ও কর অঞ্চলের রাজস্ব আদায় ও সেবা প্রদান প্রায় বন্ধ রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন। যদিও এনবিআর থেকে শুক্রবার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, নিজ নিজ দপ্তরে অবস্থান করে সেবা প্রদান ও রাজস্ব আদায় করার। এছাড়া বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা কাস্টম হাউসের এক রাজস্ব কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ঢাকা কাস্টম হাউসে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা কার্যক্রম সচল রয়েছে। তবে আমদানি-রপ্তানি ও পণ্য শুল্কায়নের সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন না। তবে আইসিডি কমলাপুর কাস্টম হাউস, পানগাঁও, বেনাপোল, মোংলা কাস্টম হাউস ও অন্যান্য শুল্ক স্টেশনেও কোন কার্যক্রম চলছে না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তবে সব বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক যাত্রী সেবা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টম অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি রেজাউল করিম স্বপন বলেন, ‘কাস্টম কর্মকর্তাদের “কমপ্লিট শাটডাউন” কর্মসূচির কারণে কাস্টম হাউসে কোনো কাজ হচ্ছে না। আমরা আগে থেকেই আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়টি জানিয়েছি। ফলে সিএন্ডএফ এজেন্টরাও কাস্টম হাউসে আসেনি। কাস্টমস কর্মকর্তাদের না থাকায় বিভিন্ন ডিপোতেও কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।’
উল্লেখ্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামের দুটি বিভাগ করে গত ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর প্রতিবাদে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছেন রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এসব কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। তাদের দাবি- সরকার কর্তৃক চলতি বছরের ২৫ মে জারিকৃত প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী-ই একটি টেকসই সংস্কার করতে হবে। দাবিগুলো হচ্ছে-
১। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত করতে হবে।
২। বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ও বিসিএস (কর) ক্যাডারের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালীকরণ এবং একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে রাজস্ব নীতি পৃথকীকরণের কাঠামো কি রূপে প্রণীত হবে তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে হবে।
৩। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালীকরণ এবং রাজস্ব নীতি প্রণয়ন কার্যক্রম পৃথকীকরণের লক্ষ্যে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জারিকৃত অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সকল সংশোধনী আনতে হবে।