গেল ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘তাণ্ডব’ ও ‘ইনসাফ’ সিনেমার বেশ কয়েকটি গানের সংগীতায়োজন করেছেন নাভেদ পারভেজ। একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমায় কাজ করে আলোচনায় উঠে এসেছে তার নাম। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই তরুণ সংগীত পরিচালক তার শিল্পসাধনা, সংগ্রাম, পথচলা আর স্বপ্ন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ইত্তেফাকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শৈবাল আদিত্য
আপনার সংগীতের প্রতি ভালোবাসার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে উঠেছেন, বিশ্ব-সংগীতের সঙ্গে ব্যাপক পরিচিতি ঘটেছে, তবুও কেন বাংলাদেশের গান আপনাকে সবচেয়ে বেশি টেনেছে?
আমি তখন আমেরিকাতে ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আমার বন্ধু-বান্ধবরা হিপ হপ/স্প্যানিশ গান শুনতো, আমিও শুনতাম এবং মনে হতো এই ধরণের গান তো খুবই ইউনিক এবং শুনে খুবই মজা পেতাম, তখনকার সময়ে বাংলাদেশে হাবিব ওয়াহিদ/ফুয়াদ আল মুক্তাদির ভাই একটা নতুন ধরণের মিউজিক্যাল ট্রেন্ড এবং নতুন সাউন্ড নিয়ে আসলো, যেটা আমাকে ব্যাপক প্রভাবিত করে, সে সময় আমার বয়স ছিলো ১৩, দেশ নিয়ে অনেক ভাবতাম, মন পড়ে থাকতো বাংলাদেশে। আমেরিকায় থাকা সত্ত্বেও বাসায় আমাদের পুরো বাঙালিয়ানা কালচার ছিলো, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের গান আমাকে বেশ প্রভাবিত করে।
হাবিব ওয়াহিদ, ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের অ্যালবামগুলো আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছে? বিশেষ করে কোন গানগুলো আপনাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল?
অনেকটা প্রভাবিত করেছে। হাবিব ওয়াহিদ ভাইয়ের ‘কৃষ্ণ’, ‘মায়া’, ‘শোনো’ অ্যালবামগুলো, ফুয়াদ আল মুক্তাদির ভাইয়ের ‘ভ্যারিয়েশন ২৫’, ‘রি-এভোলুশন’ অ্যালবাম আমাকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছে। তাদের প্রত্যেক অ্যালবামের সবকটি গান আমাকে সমান প্রভাবিত করে, আলাদা ভাবে কোনো নির্দিষ্ট গান ছিলো না।
পরিবার ও পড়াশোনার চাপের মাঝে কীভাবে সংগীতচর্চা চালিয়ে গেছেন?
আমার বাবা-মা শুরুতে চাইতেন না আমি মিউজিক নিয়ে পড়ে থাকি, এমনকি তারা তখন হয়তো এতটা ভাবেনওনি যে আমি মিউজিক নিয়ে এতদূর আসবো। সত্যি কথা বলতে ২০০৫ সালে আমেরিকা যাওয়ার পর আমরা ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়ি। একটা ছোট্ট এক বেডরুমের বাসায় আমি, আমার বড় ভাই, আব্বু আম্মু থাকতাম। এক পর্যায়ে জীবিকার তাগিদে আঠারো বছর বয়সেই আমি একটা কফি শপে (ডানকিন ডোনাট) জব করা শুরু করি, তখন আমি হাই স্কুলে পড়তাম। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত থাকতো স্কুল, স্কুল শেষে কফি শপে কাজ করা (বিকাল থেকে রাত), এরপর রাতে বাসায় ফিরে কয়েক ঘন্টা মিউজিক করতাম। বাবা-মা ভাবতেন হয়তো আমি রাত জেগে স্কুলের এসাইনমেন্ট করতাম, কিন্তু ওই সময় মিউজিকে সময় দিতাম। আবার যখন সকালে স্কুলে যেতাম, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে, টিচারের দেওয়া এসাইনমেন্ট করে ফেলতাম, নিজের প্রতি একটা সৎ বিশ্বাস ছিলো, হয়তো মিউজিক নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলে কিছু একটা করতে পারবো!
অনেক কাজ পাঠিয়েও যখন কেউ ডাকেনি, তখন হতাশা কীভাবে সামলেছেন?
খুব খারাপ লাগতো! একটা ঘটনা বলি, এমনও হয়েছে তখনকার সময়ে এক প্রবাসী শিল্পী আমাকে বলে, ‘নাভেদ, তুমি আমার নেক্সট অ্যালবামের পুরো কাজ করবে’, আমি তো আনন্দে আত্মহারা, কি কি গান থাকবে, কেমন সাউন্ড থাকবে, সেসব নিয়ে ডিজাইন করি, গানের ট্র্যাক বানানো শুরু করে দেই। এর এক মাস পর দেখি সেই শিল্পী দেশে গিয়ে পুরো একটা অ্যালবাম করে ফেলেছেন। শিল্পীকে জিজ্ঞাসা করি, শিল্পী সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে পারেননি। অনেক ভেঙে পরি, কিন্তু তখন নিজেকে সান্তনা দেই ‘কেএফসি’র মালিক যদি অনেক চেষ্টার পর ‘কেএফসি’ ব্র্যান্ড বানাতে পারেন, আমিও চেষ্টা করে যাই, আর যেহেতু আমার বয়স কম, হয়তো সামনে কোনো ভালো কিছু অপেক্ষা করছে!
নির্মাতা আশিকুর রহমানের সঙ্গে প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? ‘শুধু একবার বল’ গানটি আপনার ক্যারিয়ারে কী ধরনের পরিবর্তন এনেছিল?
এক কথায় অসাধারণ! যখন মিউজিক নিয়ে কোনো কিছু হচ্ছিলো না, ওনার সাথে পরিচয় হবার পর, আমার কিছু ডেমো শোনার পর, একদম সরাসরি ফিল্মের কাজের অফার দিয়ে দেন। পারিশ্রমিক নিয়ে যখন তার দুইদিন পর প্রযোজকের সাথে কথা হয়, তখন বিশ্বাস হয় যে আসলেই ফিল্মে কাজ করছি। ‘শুধু একবার বলো’ রিলিজ হওয়ার পর ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর মানুষ আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়, সাধুবাদ জানায়!
ভারতীয় সংগীত পরিচালক আমাল মালিকের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? ‘সুরাজ ডুবা হ্যায়’ গানে আপনার অবদান ঠিক কোন অংশে ছিল?
এক কথায় দারুণ! তার সাথে কাজের সুবাদে, বলিউডে কিভাবে গান তৈরী করা হয়, এবং মানের ক্ষেত্রে তারা যে কোনো আপোষ করে না, তার একটা স্বচ্ছ ধারণা হয়। ‘সুরাজ ডুবা হ্যায়’ গানে আমি রিদম/বেজ/কীবোর্ড সেকশন ডিজাইন/প্রোগ্রামিং করি, স্পেশিয়ালি গানের দুই অন্তরায়।
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে আসা ছিল আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি’- এটা বললেন কেন?
হ্যাঁ, কারণ আমি তখন আমার বিবিএ কমপ্লিট করি, চাইলেই এখানে যে কোনো প্রতিষ্ঠানে আরামসে একটা ভালো চাকরি পাওয়া যেতো, কিন্তু ভাবতাম মিউজিক নিয়ে একটা ট্রাই করি। দেশে গিয়ে দেখি কি হয়, একটু যদি চেষ্টা না করি, তাহলে সারাজীবন সেটা আফসোস থেকে যাবে! সেই চিন্তা থেকে ঝুঁকিটা নেওয়া।
দেশে ফিরে যাদের সহযোগিতা পেয়েছেন, তাদের কার কী ভূমিকা ছিল আপনার ক্যারিয়ারে?
দেশে আসার আগে থেকেই আমার পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ ভাইয়ের সাথে পরিচয় ছিলো। আমেরিকা থাকা অবস্থায়ই ওনার বিজ্ঞাপন/নাটকে কাজ করা শুরু করি। দেশে এসে ওনার নাটক/সিনেমায় কাজ নিয়মিত করা শুরু করি। দেশে আসার পর সংগীত শিল্পী জুয়েল মোর্শেদ ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। উনি প্রচুর গাইডলাইন দিয়েছেন, যা পরবর্তী সময়ে আমার মিউজিক ক্যারিয়ার এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ধ্রুব মিউজিক স্টেশনের ধ্রুব’দা আমাকে বেশ সাপোর্ট দিয়েছেন, বিজ্ঞাপন সাইডে নির্মাতা মোর্শেদ রাকিন ভাই আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। এ ছাড়া সংগীতাঙ্গনের আরো অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন সময়ে আমাকে সাপোর্ট দিয়েছেন।
কোভিডের সময় সংগীতচর্চা বন্ধ করে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি নেওয়া- এটা কি পেছনের দিকে ফেরা মনে হয়েছিল? এ নিয়ে যদি কিছু বলেন-
সংগীত চর্চা বন্ধ করে চাকরি নেওয়া ব্যাপারটা আসলে তা না, সংগীত চর্চা তখনো চলছিল। কোভিডের সময় ইন্ডাস্ট্রির কারো কোনো কাজ ছিল না, তখন ভাবলাম সামনে চলতে হলে দুটো প্রফেশন থাকা দরকার, যাতে আর্থিক চিন্তা ভাবনা না করতে হয়। এ ছাড়াও আমার বাবা মা গুরুতর অসুস্থ ছিলেন এবং আমেরিকায় তাদের নিয়মিত হেলথ ট্রিটমেন্ট দরকার ছিল। ছেলে হিসেবে তাদের পাশে থাকাটা আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি। সব কিছু বিবেচনা করেই ফিরে যাওয়া এবং আরেকটি প্রফেশনের সাথে যুক্ত হওয়া।
‘চলো নিরালায়’ গানটি কীভাবে নাটক থেকে ‘পরাণ’ সিনেমায় চলে এলো? গানটির নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলুন।
‘চলো নিরালায়’ গানটি মূলত বাংলাদেশের খুবই জনপ্রিয় এক নির্মাতার নাটকের জন্য শুনিয়েছিলাম, ওনার গানটি ভালো লাগলেও বলে দেন এটা নাটকে নয়, সিনেমায় ইউজ করার মতন গান। এর বেশ কিছুদিন পর, রায়হান রাফী ভাই ‘পরাণ’ সিনেমার জন্য গান চান। তিনি গল্প শুনান। গল্প শোনার পর আমার মনে হয়েছিলো, এই গানটি সিনেমার সিচুয়েশনের সাথে যায়। আমি গান শোনানোর পর সঙ্গে সঙ্গে রাফী ভাই দারুণ পছন্দ করে ফেলেন। গানটির গীতিকার জনি হক ভাই, গেয়েছেন অয়ন চাকলাদার এবং আতিয়া আনিশা। গানটির নির্মাণ সম্পর্কে বলতে আমি আসলে এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করি, সেটা গানের লেখায়, কিংবা গায়কীতে। গান হিট হবে না ফ্লপ হবে সে চিন্তা করে আমি কখনো গান বানাই না। ‘চলো নিরালায়’ গানের কথা এবং গায়কী গানটিকে একটি অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।
‘তুফান’, ‘লিডার’, ‘ওমর’, ‘তাণ্ডব’, ‘ইনসাফ’- এতগুলো সিনেমায় কাজ করা প্রসঙ্গে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? কোন সিনেমার গান করতে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং লেগেছে?
এক কথায় দারুণ! সিনেমার গানে সব সময় একটি হাইপ থাকে, চ্যালেঞ্জ থাকে, এক্সাইটমেন্ট থাকে, আবার দায়িত্ববোধও থাকে। যেমন ধরেন একটা সিনেমার গান কিন্তু ১০০০ বিলবোর্ডের সমান। সিনেমার গান ভালো হলে দর্শকদের হলে টানতে বাধ্য করে। আমি এ যাবৎকালে যত সিনেমার গান করেছি, সব সিনেমার গানই চ্যালেঞ্জিং ছিলো। কারণ পরিচালক/প্রযোজক তাদের সিনেমার গান নিয়ে আকাশচুম্বী এক্সপেক্টেশন করেন, যেহেতু প্রচুর লগ্নি করা হয়, সিনেমার গানে কোনো কম্প্রোমাইজ করা যায় না।
আপনি যেসব গান করেছেন, সেগুলোতে আধুনিকতা, র্যাপ এবং ট্র্যাপ সাউন্ডের সংমিশ্রণ দেখা যায়। সংগীতায়োজনে আপনি কোন ফর্মুলা অনুসরণ করেন?
আসলে কোনো ফর্মুলা নেই, গানে যখন এলিমেন্ট লাগে সেটা ইউজ করি, এ ছাড়া আমার বেশ কিছু রিলিজড গান আছে, এক্যোস্টিক বেজড। গানগুলোতে প্রচুর লাইভ ইনস্ট্রুমেন্ট ইউজ করা, সেসব গান হয়তো সেভাবে অন্য গানগুলোর মতন ছড়িয়ে যায়নি।
আপনার ইউটিউব প্রজেক্ট নিয়ে কিছু বলুন। দেশ-বিদেশের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল- এ নিয়ে কিছু বলুন...
এই মুহূর্তে প্রায় ১৫-২০টি গানের কাজ চলছে, সব জনরায় একটি মিউজিক ক্যাটালগ বিল্ড-আপ করার চেষ্টা করছি, এখন পর্যন্ত যাদের সাথে কাজ করা হয়েছে এক কথায় দারুণ অভিজ্ঞতা! আমার ইউটিউব চ্যানেলে গানগুলো রেগুলার প্রকাশ হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংগীতের ভবিষ্যৎ আপনি কীভাবে দেখছেন? নতুন প্রজন্মের সংগীত পরিচালক বা গায়ক-গায়িকাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
আমার মনে হয় টেকনোলজিকাল সাইডে আমাদের দেশের মিউজিকের সাউন্ড অনেক আপগ্রেড হয়েছে। নতুন নতুন আর্টিস্ট আসছেন, নতুন ধরণের গান উপহার দিচ্ছেন, সেটা খুবই পজিটিভ। আর আমার পরামর্শ দেওয়ার কিছু নেই, আমি পরামর্শ দেওয়ার মতন এখনো বড় কোনো শিল্পী হয়ে উঠিনি।
সংগীতকে আপনি কী হিসেবে দেখেন- শুধু পেশা, নাকি সাধনা?
আমি সাধনা হিসেবেই দেখি। একটা গান করে কত টাকা কামাবো, সে হিসেব করে তো কখনো গান করিনি। কেউ যদি সাধনা করে, তার যদি অসামান্য ট্যালেন্ট থাকে, টাকা পয়সা এমনিতেই এক সময় তার পিছনে ঘুরবে।
বর্তমানে হাতে কি কি কাজ রয়েছে একটু যদি বলতেন। ভবিষ্যতে কোনো আন্তর্জাতিক প্রজেক্টে কাজ করার পরিকল্পনা আছে কি?
কয়েকদিন আগে তো ‘তান্ডব’, ‘ইনসাফ’ রিলিজ পেলো, এখন কয়েকজন ফিল্ম ডিরেক্টরের সাথে কথা চলছে তাদের আপকামিং ফিল্ম নিয়ে। আপাতত কোনো কিছুই এখনো ফাইনাল না। এ ছাড়া আমি আমার ইউটিউব চ্যানেলের জন্য নিয়মিত গান করে যাচ্ছি।