ঢাকায় আইএসের মালয়েশিয়া নেটওয়ার্কের সন্ধান করতে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা। মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরত পাঠানো তিন জনের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) কাজ করছে। এর আগে শুক্রবার ভোরে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে মালয়েশিয়া থেকে ফেরত ঐ তিন জনকে হেফাজতে নেয় এটিইউ। বারিধারার এটিইউ সদর দপ্তরে নিয়ে তাদেরকে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করে এটিইউর তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি চৌকশ টিম। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদেরকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে শুক্রবার বিকালে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম মিজবাহ উর রহমানের আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
আদালতে বিমানবন্দর থানার প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-পরিদর্শক বখতিয়ার আলম জানান, গত শুক্রবার ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৫৪ ধারায় আসামিদের আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক আবেদন করে পুলিশ। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তবে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।
অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ডিআইজি আক্কাস উদ্দিন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে।’ মালয়েশিয়া থেকে ফেরত পাঠানো এই তিন জনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আগে কোনো অপরাধের অভিযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সেগুলো যাচাই করছি, ওদের তো কেবল পাঠানো হয়েছে।’
এটিইউর তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ঐ তিন জনের মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে দেশে কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না, তা তদন্ত করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় থাকা অবস্থায় এদেশের আরও কারো সাথে হোয়াটসআপ, ম্যাসেঞ্জার ও অন্যান্য ডিজিটাল প্লাটফরমের গ্রুপে কথোপকথন হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে তদন্তে জোর দেওয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বিশেষ অভিযান চালিয়ে মালয়েশিয়ার পুলিশ বাংলাদেশের ৩৬ জনকে গ্রেফতার করে। গত ২৭ জুন মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে ‘জঙ্গিবাদে জড়িত’ থাকার অভিযোগে মালয়েশিয়ায় গ্রেফতার বাংলাদেশিদের দলটি সিরিয়া ও বাংলাদেশে ‘ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সেলগুলোকে’ অর্থ পাঠাত।
মালয়েশিয়া পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ খালিদ ইসমাইল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “চলতি বছরের এপ্রিল থেকে পরিচালিত ধারাবাহিক অভিযানে ঐ ৩৬ বাংলাদেশিকে আটক করা হয়; তারা মূলত কারখানা, নির্মাণ ও সেবা খাতে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশিদের ঐ চক্রটি অন্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে থেকে সদস্য বাড়াচ্ছিল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে ‘উগ্রবাদী মতাদর্শ’ ছড়াচ্ছিল। এই চক্র আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস ও ই-ওয়ালেট ব্যবহার করে সিরিয়া ও বাংলাদেশে ‘আইএসের জন্য’ অর্থ পাঠাত। মালয়েশিয়া পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাউন্টার টেরোরিজম ডিভিশন অর্থ সংগ্রহের প্রমাণ পেয়েছে।”
মালয়েশিয়া পুলিশ প্রধান আরও জানান, আটককৃতদের মধ্যে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। ১৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর ১৬ জন এখনো পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন খালিদ ইসমাইল।
মালয়েশিয়া পুলিশের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যম মালয়েশিয়া স্টার লিখেছে, ‘গেরাকান মিলিটান র্যাডিকাল বাংলাদেশ’ বা ‘জিএমআরবি’ নামে পরিচিত এই চক্র হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো অ্যাপে সদস্য সংগ্রহ এবং উগ্র মতবাদের প্রচার করে আসছিল। আমাদের ধারণা, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তাদের সদস্য সংখ্যা ১০০ থেকে ১৫০ জনের মতো। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, প্রত্যেক সদস্যকে বছরে ৫০০ রিংগিত ফি দিতে হয়। তবে অনুদানের পরিমাণ নির্ভর করছে সদস্যদের ওপর।
কোনো রকম জঙ্গিবাদ প্রশ্রয় নয়:
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রবাসীকল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, মালয়েশিয়ার মাটিতে হোক, বাংলাদেশের মাটিতে হোক, কোনো রকম জঙ্গিবাদ আমরা প্রশ্রয় দেব না। প্রমাণ পেলে এই ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থান নিব। তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে আটক হয়ে যারা ফেরত আসবেন, সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’
বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘মালয়েশিয়া আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। কয়েক লাখ বাঙালি ওখানে কাজ করছে। এই ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, কয়েক জনের বিরুদ্ধে এ রকম অভিযোগ আসে জঙ্গিবাদে জড়ানোর, এটা আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর। আমাদের এবং মালয়েশিয়ার দুই দেশের জন্যই এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয়। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা মালয়েশিয়ার উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করছি, একসাথে কাজ করব। মালয়েশিয়ার মাটিতে হোক, বাংলাদেশের মাটিতে হোক, কোনো রকম জঙ্গিবাদ আমরা প্রশ্রয় দেব না। এই ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থান নিব।’
তদন্তে মালয়েশিয়াকে সহযোগিতা করবে ঢাকা:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে তদন্তে দেশটির সরকারকে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। গতকাল শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদ, সহিংস উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছে বাংলাদেশ এবং এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ‘বিষয়টি জানার পর কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন, মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পরিচয় ও তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কিত তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর অনুরোধ করা হচ্ছে।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে মালয়েশিয়ার আদালতে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। বাকিগুলোর তদন্ত প্রক্রিয়াধীন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চলমান আইনি প্রক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। বাংলাদেশ হাইকমিশন প্রবাসী বাংলাদেশিদের যেখানে প্রয়োজন সেখানে প্রয়োজনীয় সমর্থন দেবে।’