শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ওরা বড় হওয়ার স্বপ্নে বিভোর

আপডেট : ১১ জুন ২০২১, ১৩:০৩

ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে খেলছিল দুই ভাইবোন রিপন (৬) ও সুবর্ণা (৯)। একটু দূরেই ওদের বয়সি সবুজ, পরাণ, রিয়াজ ও মাইসাও হাতে হাত রেখে গোল হয়ে খেলছে। ওদের কাছেই জানা গেল ওখানেই পাটি পেতে মাটিতে তাদের স্কুল বসে।

সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল বলে তাদের ভাইয়া পড়াতে আসেনি। সুবর্ণা জানাল, তাদের স্কুল সচরাচর বন্ধ হয় না। শুধু বৃষ্টি হলেই বন্ধ থাকে। আর যেদিন স্কুল বন্ধ থাকে, সেদিন তাদের মন খুব খারাপ থাকে। কথা হচ্ছিল হাইকোর্ট মাজারের গেটের পাশে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে। তারা এই গেটের কাছে স্কুলে পড়াশুনা করে। তাদের কেউ পুলিশ অফিসার, কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। আর তাদের এই স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করছে তাদের দরিদ্র বাবা-মা ও স্কুল পরিচালনা সংগঠন ‘জুম বাংলা ইয়ুথ ফাউন্ডেশন’।

হাইকোর্ট মাজারগেটে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য ভাতের দোকান চালান নার্গিস। তার মেয়েও এই স্কুলে পড়ছে চার বছর ধরে। এখন তার বোনের ছেলেমেয়েও এখানে পড়া শুরু করেছে। মো. সালাম ৩০ বছর ধরে রিকশা চালান হাইকোর্ট এলাকায়। কয়েক বছর ধরে দেখছেন মাজারের দিক হয়ে কার্জন হলের দিকে যে গেট আছে, সেই গেটের পাশে ৪০/৫০ জন দরিদ্র শিশু জড়ো হয়ে পড়ছে। ৫০ বছর বয়সি শেফালী বেগম জানান, তিনি এই স্কুলের জায়গাটি ঝাড়ু দেন। বাচ্চাদের পানি খাওয়ান, অর্থাৎ স্কুল দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এখান থেকে কোনো টাকাপয়সা নেন না। কারণ, তার দুই নাতিও এই স্কুলে পড়ে।

এখানে যারা পড়াশোনা করে, তাদের কেউ থাকে আশপাশের রাস্তা কিংবা মাজারের বারান্দায়। শিশু রিয়াজ জানালো, সে ইংরেজি ছড়া বলতে পারে। শোনাল ‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার’ ছড়া । তারপর শিশুদের মধ্যে শুরু হলো কার আগে কে কী শোনাবে তার প্রতিযোগিতা। একটু দূরে কাঁটাতারের বেড়ার পাশ ঘেঁষে নীল রঙের পলিথিনের ঘরে বসে পড়ছিল আরিফ। পড়া মুখস্থ করতে হবে বলে সেদিন খেলতে যায়নি। পথের ধারে বেড়ে উঠা এই শিশুগুলো পথেই শিক্ষা নিচ্ছে।

এখানে চায়ের দোকানের মজিদ মিয়া জানান, সপ্তাহে তিন দিন পাঠদান হয় স্কুলে। ছিন্নমূল এই শিশুদের স্কুলে পড়ান আল আমিন। তিনি জানান, পথের এই শিশুদের অক্ষর জ্ঞান দেওয়ার পাশাপাশি সদাচরণ শিক্ষা দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যে তারা গুলিস্তান, নাট্যমঞ্চে, ভিক্টোরিয়া পার্ক আর হাইকোর্ট মাজারে শিশুদের পড়ান। এ ছাড়াও হাতিরঝিল ও সেগুনবাগিচায় তাদের একাডেমিক স্কুল আছে। যেখানে শিশুদের পড়াশোনার জন্য তাদের খোলা আকাশের নিচে বসতে হয় না।

ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শাহীন প্রধান জানান, ২০১৬ সাল থেকে তারা এই স্কুল পরিচালনা করছেন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তাদের আটটি স্কুলে সাড়ে ৪০০ দরিদ্র ছেলেমেয়ে পড়াশুনা করছে। দেশের সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করেন। কীভাবে এই স্কুল করার কথা ভাবলেন প্রশ্ন করলে বলেন, ‘পথের শিশুদের দেখে মনে হলো আমাদের দেশের অনেক পরিবার আজও পথে থাকে, তাদের ভাত খেতেই কষ্ট হয়। কীভাবে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করাবে। আর সদাচরণ শিক্ষা দেওয়াতো অনেক দূরের কথা।

কিন্তু এর অভাবেই ছোট্ট শিশুরা দিনে দিনে বড় হয়ে নানাবিধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যদি তাদের ভালোমন্দ শিক্ষা দেওয়া যায় তবে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বদলাবে, এই চিন্তা থেকেই পথ চলা শুরু।’ তাদের মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন দেখছেন প্রশ্ন করলে বলেন, শুরুর দিকে ওদেরকে প্রশ্ন করলে ওরা বলত বড় হয়ে রিকশা চালাবে, চায়ের দোকান দেবে। ওরা আসলে বড় হওয়ার জগত্টাই অনুভব করতে পারত না। আর এখন প্রশ্ন করলে বলে পুলিশ অফিসার হবে, ডাক্তার হবে।

ইত্তেফাক/এসআই