শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জেগে উঠছে আদিম যোদ্ধারা!

আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২০, ০৯:৪৮

প্রকৃতির কি বিশেষ অনুভূতি আছে? প্রকৃতি কি নিজেকে রক্ষার জন্য মাঝেমধ্যে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে? ১০ হাজার বছর আগের কথা চিন্তা করে দেখুন একবার। তখন এই প্রকৃতিজগতে একটি শুয়োপোকার যেই প্রভাব ছিল, মানবজাতির তার চেয়ে বেশি প্রভাব ছিল না। ঐ সময় দুনিয়ায় মানুষ ছিল দশমিক ১ শতাংশ আর বন্যপ্রাণ ছিল ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ। আজ মানুষ হয়েছে ৩২ ভাগ, গবাদি প্রাণিসম্পদ ৬৭ ভাগ আর বন্যপ্রাণী মাত্র এক ভাগ! দুনিয়া জুড়ে নির্দয়ভাবে উধাও হয়েছে বন্যপ্রাণী। প্রকৃতির বৃহত্ একটি অংশকে উচ্ছেদ করে নিজের বসতি গড়েছে মানুষ। প্রকৃতিতে এক মানুষ ছাড়া আর সব প্রজাতির বিচরণস্থল ও তাদের বিকাশের পথ ক্রমশ আটকে দেওয়া হয়েছে। সভ্যতা গড়ার নামে মানুষ নষ্ট করে দিয়েছে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে এত বেশি পরিমাণে কার্বন নিঃসারণ করেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন এখন পুরো পৃথিবীকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে।

মনে পড়ে শেষ কবে শহুরে বাসাবাড়িতে বসে সকালে ঘুম ভেঙেছে পাখির কিচিরমিচির শব্দে? ভোরের বাতাসে শেষ কবে পেয়েছেন শুদ্ধতার অনুভূতি? কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে নাকি ডলফিনদের জলকেলি দেখা যাচ্ছে! শেষ কবে এমন সুনসান সৈকত পেয়েছে ডলফিনরা? শোনা যায়, ১৯৯১ সালে নাকি শেষবারের মতো কক্সবাজারে ডলফিনদের খেলে বেড়াতে দেখা গেছিল। আর এখন, এই ২০২০ সালে, করোনার কালবেলায়। সারা পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ কোভিড-১৯-এর ভয়ে ঘরে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে, আর প্রকৃতি জগত্ হেসে উঠছে খিলখিলিয়ে, নিজেদের খেয়ালখুশিতে খেলে বেড়াচ্ছে সভ্যতা শুরুর আগের জামানার মতো। বাতাসে নেই বিষাক্ত ধোঁয়া, ধুলিকণার বাড়াবাড়ি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাইবিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’ গত শনিবার জানিয়েছে, বায়ুমান সূচক (একিউআই) ইনডেক্সে ১০ নম্বরে নেমে এসেছে ঢাকা। অথচ গত ছয় মাস ধরেই দিনের বেশির ভাগ সময় ঢাকা প্রথম স্থান দখলে রেখেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩০০-এর ওপরে গেলে তাকে দুর্যোগ অবস্থা বলে। এই সূচক ৩৯১ পর্যন্ত উঠেছিল। অথচ শনিবার সেই সূচক নেমে হয়েছে ১২১-এ! বায়ুদূষণ কী ভয়াবহ নীরব ঘাতক, তা বুঝতে ছোট্ট কিছু পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর শুধু বাংলাদেশেই পৌনে ২ লাখ লোক মারা যায়। এমনটিই জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আর সারা বিশ্বে মারা যায় ৮৩ লাখ মানুষ। যত লোকের অকালমৃত্যু হয়, তার প্রায় ১৫ শতাংশই মারা যায় নানা ধরনের দূষণে।

করোনা ভাইরাস যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, মানুষকে বন্দি করে রাখলে প্রকৃতিতে কী কী পরিবর্তন আসে, প্রকৃতি কীভাবে নিজেকে সারিয়ে তোলে, কীভাবে কার্বন নিঃসারণ তলানিতে চলে যায়, কীভাবে মহাকালের ঘড়ি উলটো দিকে চলতে শুরু করে! করোনা, যার অর্থ মুকুট (গ্রিক শব্দ), সেই মুকুটধারী ভাইরাসটির পরিবারের গুষ্টি একদম আনকোরা এবং ছোটো নয়। করোনা গোত্রের ভাইরাসকে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় ১৯৬০ সালে। এই ভাইরাস-পরিবারে দুই শতাধিক সদস্য থাকলেও মানুষের ভেতর সংক্রমণের জন্য ইতিপূর্বে ছয়টি ভাইরাস চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে এই মুহূর্তে বিশ্বত্রাস তৈরি করেছে ২০১৯ সনে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোচিত ‘নোবেল করোনা ভাইরাস (২০১৯ এনসিওভি)’। এটি হলো মানুষে সংক্রমিত হওয়া করোনার সপ্তম প্রজাতি। এই কোভিড-১৯ ভাইরাসটি গবেষণাগারে তৈরি কি না—এ নিয়ে বিপুল বির্তক হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন জার্নালে। তবে এমন জটিল ভাইরাস যে প্রাকৃতিক অভিযোজন থেকেই তৈরি হয়েছে সে বিষয়টি বিশেষজ্ঞরা অনেকবার স্পষ্ট করে বলেছেন। সেটা মানুষের শরীরে বাদুড় থেকে এসেছে, নাকি বনরুই থেকে—সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিশ্বে কেন একের পর এক এমন সব জটিল জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে চলেছে? এক সংক্রমণের ধাক্কা সামাল না দিতেই হাজির হচ্ছে আরেক বিপদ। সার্স, মার্স, নিপাহ, ইবোলা, হেনিপা, বার্ড ফ্লু ভাইরাসের ভয়াবহতাকে কিছুটা সামলানো গেলেও কোভিড-১৯ কাঁপিয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে। সুতরাং প্রকৃতিতে কেন এমন সব মারণ জীবাণু জেগে উঠছে, এর উত্তর খোঁজা জরুরি বলে মনে করেন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা। আর সেসব বিষয়ে কত ধরনের প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে নেচার, সায়েন্স, দি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনফেকশাস ডিজিস, সিডিসি, ডাব্লিউএইচওর জার্নালে। সেসবের সুলুকসন্ধানে মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে। তার আগে একটু খোঁজ নিয়ে দেখা যাক পৃথিবীর আদিমতম যুদ্ধের বিষয়ে।

আপনি কি বলতে পারবেন পৃথিবীর আদিমতম এবং দীর্ঘতম যুদ্ধ কোনটা? সাধারণ জ্ঞানের বই থেকে হয়তো জানতে পারবেন, প্রায় ৭০০ বছর ধরে চলেছিল ইংরেজ-ফরাসি যুদ্ধ। বিংশ শতকে চলেছে দুটো মহাযুদ্ধ। কিন্তু এসব যুদ্ধ নাকি আদিমতম যুদ্ধের কাছে নেহাতই শিশু! আসলে কোটি-কোটি বছর ধরে প্রাণিজগতের মধ্যে চলছে ভয়াবহ সংঘাত। কখনো জীবাণুরা সেই লড়াইয়ে সাময়িক জিতে গেছে, প্রাণ গেছে অসংখ্য মানুষের। রোগপ্রতিরোধের শক্তি গড়ে উঠেছে সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে। আবার সেই রোগপ্রতিরোধের মোকাবিলা করতে জীবাণুরা মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেদের বদলে ফেলেছে। ১৬৬৫ সালে দ্য রয়েল সোসাইটির দুই গবেষক রবার্ট হুক এবং অ্যান্টনি ভ্যান যখন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে প্রথম ক্ষুদ্র জীবের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন, তখনো তারা জানতেন না মানুষের অসুস্থতার নেপথ্যে বড়ো শত্রু এই জীবাণু। এটা জানতে বিজ্ঞানকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো দেড় শ বছর। এর ভেতরে এবং আগে পৃথিবীতে যত জীবাণুঘটিত মহামারি এসেছে মানুষ কল্পনা করেছে অদ্ভুত সব কারণ। এজন্যই ম্যালেরিয়ার অর্থ ‘দূষিত বাতাস’। চোদ্দো শতকে পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল প্লেগের কারণে। কিন্তু প্লেগের নেপথ্যে যে একটা জীবাণু কাজ করছে, সেটা জানত না মানুষ। বিংশ শতকের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধে যত না মানুষ মারা গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল যুদ্ধপরবর্তী স্প্যানিশ ফ্লুতে।

বাস্তবতা হলো, বিজ্ঞানের বেশির ভাগ শাখা এখন যেই বিপুল পরাক্রমে অগ্রগামী, সেই তুলনায় চিকিত্সাবিজ্ঞান বহু যোজন দূরে। আমরা হয়তো টিকার মাধ্যমে গুটি বসন্ত, পোলিওর মতো রোগ বিশ্ব থেকে মুছে দিতে পারছি, কিন্তু সব ভাইরাসকে এত সহজে পরাস্ত করা যায় না। আর প্রাচীন কোনো জীবাণু যদি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে আবার ফিরে আসে, তখন কী উপায় হবে মানবজাতির? মানুষ এই পৃথিবীর তাবত্ প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের যেই বিশাল ক্ষতি করেছে এবং করে চলেছে, তার প্রতিশোধ নিতে যদি জেগে ওঠে আদিম যুগের নির্মম জীবাণু যোদ্ধারা—যেসব ভয়াবহ জীবাণু সুপ্ত রয়েছে হিমবাহের বরফের নিচে! কৃষ্ণকালো সমুদ্রের অন্ধকারে বাস করে তারা। বাস করে বিচিত্র সব প্রাণীর শরীরে। বর্তমানে এমন আশঙ্কাই করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাদের আশঙ্কা, বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে লক্ষ বছরের পুরোনো জীবাণুরা। জমে যাওয়া মাটি, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘পারমাফ্রস্ট’ তার স্তরে স্তরে লক্ষ বছর ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে নানা ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস। উন্মুক্ত পরিবেশে থাকা জীবাণুদের বিবর্তনের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে লড়াইয়ে টিকে থাকতে নিজেরাও বিবর্তনের রাস্তায় হেঁটেছে গোটা প্রাণিজগত্। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব-উষ্ণায়নে ক্রমে গলছে বরফের স্তর। গলছে পারমাফ্রস্টের স্তরও। বহু বহু নীচের স্তরও এবার হয়ে পড়ছে উন্মুক্ত। সেই কারণেই আদিম দুনিয়া থেকে নিজেদের প্রাচীন অস্ত্র নিয়ে বর্তমান সময়ে এসে হাজির হচ্ছে এসব মাইক্রোব ও ভাইরাস। যে অস্ত্রের সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই বর্তমানের মানুষসহ গোটা প্রাণিজগতের। আশঙ্কা করা হচ্ছে কোভিড-১৯ দিয়ে এমন ভয়াবহ মহামারির শুরু। এর পর কোন জীবাণুর আবির্ভাব ঘটবে, কেউ জানে না।

তাহলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে পৃথিবীর মানুষ কী শিক্ষা নেবে? করোনা সংক্রমণ সামলানোর পাশাপাশি এই পৃথিবীর প্রকৃতিপাঠ আজ অনেক বেশি জরুরি। করোনা ভাইরাস বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমরা সবাই কেবল ‘মানুষ’। অর্থ-বিত্ত-সম্পদ এবং নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, সাদা-কালোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে স্মরণ করে বলতে হয়, ‘জগত্ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি।’ সুতরাং এই পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে সম্মিলিত উদ্যোগে।

লেখক :  তাপস কুমার দত্ত

সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন