শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চাকরি-কাজ হারিয়ে মৌসুমি অপরাধীরাও হত্যাকাণ্ডে

আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:৩২

করোনা মহামারি শুরুর প্রথম দিকে অপরাধপ্রবণতা কমে গেলেও হঠাত্ করেই বেড়ে গেছে অপরাধ ও প্রতারণার ঘটনা। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বিশ্লেষকেরা বলছেন, চাকরি চলে যাওয়া, উপার্জন না থাকাসহ নানা কারণে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। শুধু পুলিশের পক্ষে এই অপরাধীদের দমন সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর ৫০টি থানায় গত মার্চে মামলার সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৫টি। এপ্রিলে তা কমে দাঁড়ায় ৩৫২টিতে। মে মাসে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয় ৫১৮টি। আর জুনে তা আরো বেড়ে হয় ১ হাজার ১৭৭টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরাও লক্ষ করছি, অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। আসলে চাকরি হারিয়ে বহু মানুষ এখন বেকার। নিম্ন আয়ের অনেক মানুষের হাতে কাজ নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। চুরি-ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ সামনে আরো বাড়তে পারে বলেও আমরা আশঙ্কা করছি। করোনার কারণে অনেকেই মানসিক স্ট্রেচ নিতে পারবে না। ফলে আপনি দেখবেন গৃহ নির্যাতনও অনেক বেড়ে গেছে। আবার করোনায় নতুন করে আমরা প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি। এখানেও প্রযুক্তিগত প্রতারণাও বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে আপনারা দেখেছেন রক্তের প্লাজমা দেওয়ার নামে প্রতারণা হয়েছে। এখন সাইবার ক্রাইম কিন্তু আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। সবাই মিলেই এখান থেকে বের হতে হবে।’

গত ১২ জুলাই আপেল মাহমুদ ও তার স্ত্রী আলভী আক্তারকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারের পর এই দম্পতি জানিয়েছেন, আপেল মাহমুদ ভ্যানে করে জামা-কাপড় ও মৌসুমি ফল বিক্রি করতেন। করোনা মহামারি শুরুর পর তাদের উপর্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তারা জীবন চালাতে প্রতারণা করে উপার্জনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রতারণা করতে গিয়ে গত ২৪ জুন তারা বাড্ডা এলাকার ব্যবসায়ী সাঈদ নাগরকে জিম্মি করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করেন। টাকা দিতে না চাওয়ায় সাঈদকে নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি মারা যান। শুধু এই একটি ঘটনা নয়, আরো কিছু মানুষের সঙ্গে প্রতারণার কথা তারা স্বীকারও করেছেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, গ্রেফতারের পর এই দম্পতি প্রতারণা ও হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। যদিও এর আগে এদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ ছিল না। এই দম্পতির দাবি, করোনার কারণে তাদের উপার্জন না থাকায় তারা জীবন চালাতে এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। সম্প্রতি চাকরি ও কাজ হারানোর পর অপরাধকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে এমন একাধিক অপরাধীর সন্ধান আমরা পেয়েছি।

শুধু এই দম্পতি নয়, এমন অসংখ্য অপরাধীর খোঁজ পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কয়েক দিন আগে গোয়েন্দা পুলিশ সিএনজি অটোরিকশাচালক শফিকুল ইসলাম ও তার সহযোগী সিদ্দিককে রাজধানীর ৩০০ ফুট এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর শফিকুল স্বীকার করেছেন, সিএনজি চালিয়ে এখন আর আয় হচ্ছে না। এমনকি মালিকের জমার টাকাও ঠিকমতো দিতে পারছেন না। তাই যাত্রীদের জিম্মি করে ছিনতাইয়ের পথে নেমেছেন।

ফাঁকা রাস্তায় যাত্রীদের সর্বস্ব কেড়ে নেন তারা। জুলাই মাসে ৩০০ ফুট এলাকায় হারুন উর রশীদ নামে এক চা-দোকানিকে তারা হত্যা করেছেন। হারুন মহাখালী থেকে চায়ের পাতা কিনে সিএনজিতে করে দক্ষিণখানে নিজের দোকানে যাচ্ছিলেন। ৩০০ ফুটে পৌঁছালে নির্জন জায়গায় তার সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন শফিকুল ও সিদ্দিকসহ কয়েক জন। একপর্যায়ে হারুনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে এই চক্র। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মহামারির কারণে চাকরিহীনতা ও নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমে যাওয়া এর জন্য দায়ী। জীবন চালানোর জন্য অনেকে অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশের করোনীয় কী? জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ইত্তেফাককে বলেন, ‘গৃহ নির্যাতন পুলিশের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আবার প্রেমঘটিত বিষয়েও হঠাত্ করে খুনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে এসব ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এখন কেউ যদি আগে থেকে পুলিশকে কোনো বিষয়ে অবহিত করে, তাহলে পুলিশের পক্ষে এগুলো দেখা সম্ভব। অর্গানাইজ ক্রাইম বা চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ পুলিশ চেষ্টা করলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। টহল চেকপোস্ট, অভিযান বাড়িয়ে এগুলো দেখা সম্ভব। কিন্তু নতুন সংকটে মানুষের কাছে টাকা নেই, কাজও নেই। এই লোকগুলো অপরাধে নামলে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? সেটার জন্য শুধু পুলিশ দিয়ে হবে না। রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সমাজপতিসহ সবাই মিলে চেষ্টা করতে হবে। যাদের কাজ নেই তাদের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। যার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, তাকে বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে। সামাজিকভাবে চেষ্টা না হলে এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা যাবে না।’

গত রবিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রিকশায় করে বাসায় ফেরার সময় ছিনতাইকারীদের গুলিতে গুরুতর আহত হন রডের ব্যবসায়ী শুকুর আলী। গুলিস্তান সুপারমার্কেটের সামনে তিন ছিনতাইকারী তার বুকে গুলি করে সঙ্গে থাকা ৮ হাজার টাকা ও একটি স্বর্ণের চেইন ছিনতাই করে নিয়ে যায়। বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন এই ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, কয়েক দিন ধরেই গুলিস্তান সুপারমার্কেটের সামনে ছিতাইকারীদের উত্পাত বেড়ে গেছে। কিন্তু তারা গুলি করতে পারে এ কথা কখনো চিন্তাও করেননি তিনি। এর মধ্যে বেশ কয়েক জন ব্যবসায়ী ঐ এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন।

শুধু শহরে নয়, গ্রামেও মানুষের হাতে কাজ নেই। ফলে গ্রামে চুরি বেড়ে গেছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। মফস্সলে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রামে বেশ চুরির খবর তারা পাচ্ছেন। কিছু কিছু ব্যবস্থাও নিচ্ছেন। কিন্তু পেটের তাগিদে যারা চুরি করে, এদের নিবৃত্ত করা কঠিন। সামাজিকভাবে এদের পুনর্বাসন করা হলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। নতুবা এই অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলেও ধারণা দিয়েছেন বেশ কয়েক জন কর্মকর্তা।

ইত্তেফাক/এসআই