৩ মার্চ, ১৯৭১। আগের রাতে একটুও ঘুম হয়নি জাহানারা ইমামের। স্লোগান, মিছিল, কারফিউ, আর একটু পর পর সাইরেনের বিকট আওয়াজে ঘুম বারবার ভেঙে গেছে তার। বড় ছেলে রুমীকে নিয়ে মহা উদ্বেগে আছেন তিনি। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকছে ছেলেটা। মিছিল, মিটিং নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত সে।
সেদিনের খবরের কাগজে গতরাতের মিছিল ও গুলির খবর এসেছে বিস্তারিতভাবে। স্টেডিয়াম, নবাবপুর, টয়েনবী সার্কুলার রোড, ভজহরি সাহা স্ট্রিট, গ্রিন রোড, কাঁঠালবাগান, নিউ মার্কেট, ফার্মগেটে গুলিবর্ষণে বহু লোক মারা যায়, আহত হয় অনেকে। এছাড়া এদিন ১১০ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করা হয়। ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেনারেল সাহেবজাদা মোঃ ইয়াকুব খান গতরাতে এই ১১০ নম্বর সামরিক আদেশ বলে পত্রপত্রিকাসমূহে পাকিস্তানের বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত বা চিত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করেছেন। আদেশ লঙ্ঘনে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান ছিল। এসময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ছিলেন লে. জেনারেল গুল হাসান। তার লেখা ‘পাকিস্তান যখন ভাঙলো’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘শেখ ২ ও ৩ মার্চকে প্রতিবাদ দিবস হিসাবে ঘোষণা করেন।.... শেখের ঘোষণা ব্যাপক সমর্থন পেল। বিশেষ করে আমলাতন্ত্রের মধ্যে।..... ২ মার্চ বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ঢাকায় আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী তলব করা হয়।’
আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পতাকা উত্তোলনের পরপরই জানা যায় যে, ফার্মগেটে মিলিটারিরা গুলি করে ৮/৯ জনকে হত্যা করেছে। বস্তুত পহেলা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পর থেকেই সারা দেশের চেহারা পাল্টে গেছে। সেনাবাহিনীর লোকেরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। যত্রতত্র গুলি চালিয়ে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে তারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম দিনের জন্য সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ও বিভিন্ন ঘটনায় সারাদেশে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়। এদিন ছাত্রনেতারা পল্টন ময়দানে জনসভা ৩ মার্চ, ১৯৭১ পল্টন ময়দানে জনসভা করে সেখানে আবারো বাংলাদেশের পতাকা তোলেন এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। এই সমাবেশে সেদিন নিহত মানুষের লাশগুলোকে নিয়ে উপস্থিত হয় জনসাধারণ। ঢাকা ছাড়াও রংপুর এবং সিলেটে কারফিউ জারি করা হয়। এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় আগামী ১০ মার্চ ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা করা হয়, এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ তাত্ক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। এদিন বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর উদ্দেশে বলেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করেন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো।
আরও পড়ুন: নানা অঙ্গীকার নিয়ে ডাকসু নির্বাচনে নারী প্রার্থীরা
সেদিন রাতে বাসায় ফিরে রুমী নতুন এক পতাকার কথা বলছিলেন তার মা’কে। পল্টনের জনসভায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গান গাওয়ার পর নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়। রুমী কাগজ ও রঙিন পেনসিল নিয়ে এঁকে এঁকে দেখাতে লাগলেন স্বাধীন বাংলার পতাকা। সবুজের ওপর টকটকে লাল গোলাকার সূর্য, তার মধ্যে হলুদ রঙে পূর্ব বাংলার ম্যাপ। এভাবেই সারাদেশ জুড়ে রুমীর মতো লক্ষ প্রাণের মাঝে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল স্বাধীন দেশের মানচিত্র— বাংলাদেশ।
ইত্তেফাক/আরকেজি