ভোটকেন্দ্র দখল হলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনও (ইভিএম) নিরাপদ নয়। সে ক্ষেত্রে ইভিএমে পড়তে পারে জালভোট। যদিও নির্বাচন কমিশন বারবার বলছে, গোপন কক্ষে ভোটার ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। কিন্তু ইভিএমে অনুষ্ঠিত বিগত কয়েকটি নির্বাচনে বুথ দখল করে জালভোট দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এই অবস্থায় ভোটকেন্দ্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ওপর জোর দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, বুথ দখল করে ইভিএমে জাল ভোট দেওয়া সম্ভব। ভোটার এসে আঙুলের ছাপ দিয়ে ব্যালট পেপার পেল। কিন্তু দেখা গেল আরেকজন দৌড় দিয়ে গোপনকক্ষে ঢুকে তার ভোটটা দিয়ে দিল। এরকম যদি হয় তাহলে কিন্তু জাল ভোট দেওয়া সম্ভব। তবে প্রোগ্রামিং করে ইভিএমে জালভোট কখনোই সম্ভব নয় বলে তিনি দাবি করেন। কমিশনার আরো বলেন, দুষ্কৃতকারীরা কেন্দ্র দখল করে যাতে জালভোট দিতে না পারে সেজন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। কেন্দ্র বা বুথ দখলকারীদের তাত্ক্ষণিক গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দের নির্দেশ দেওয়া আছে।
ব্যালটের চেয়ে ইভিএমের খরচ একটু বেশি হলেও এর মাধ্যমে নির্বাচনী অনিয়ম দূর করা সম্ভব বলে ইসি মনে করলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ইভিএমও অরক্ষিত। বিগত সময়ে ভোটের রাতে কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটলেও এখন দিনে কেন্দ্র দখল করে ইভিএমে জালভোট দেওয়ার কিছু দৃশ্যও দেখা গেছে। এই কারণে ইভিএমে ভোটারদের উপস্থিতিও অনেকাংশ কমেছে। কেননা ভোটকেন্দ্রে ভোটারের ভোটদানের সুরক্ষার ঘাটতির কারণে ভোটদানে অনীহা রয়েছে। ইভিএম ক্রটিমুক্ত হতে পারে কিন্তু শতভাগ সুরক্ষিত নয় বলে জানিয়েছেন ইসির একাধিক কর্মকর্তা।
যেভাবে জাল ভোট পড়তে পারে : ইভিএমের দুটি ইউনিট। একটি কন্ট্রেল ইউনিট এবং অন্যটি ব্যালট ইউনিট। এর মধ্যে ব্যালট ইউনিটটি অরক্ষিত। কন্ট্রোল ইউনিটে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিংয়ের পর গোপনকক্ষে সংরক্ষিত ব্যালট ইউনিটে গিয়ে একজনের ভোট দিয়ে দিতে পারেন অন্যজন। কেননা কন্ট্রোল ইউনিটে ফিঙ্গারের ব্যবস্থা থাকলেও ব্যালট ইউনিটে তা নেই।
অবশ্য ইসি বলছে, ইভিএমের ব্যালট ইউনিট সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ও ত্রুটিমুক্ত। যদি কোনো ব্যক্তি ভোট কেন্দ্র বা গোপন কক্ষ দখল করে, সেক্ষেত্রে প্রিজাইডিং অফিসার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। এছাড়া অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করার বিধানও রয়েছে। কিন্তু বিগত উপজেলা নির্বাচনের সময় সারাদেশে অর্ধশতাধিক প্রিজাইডিং-সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ভোটে অনিয়মে যুক্ত থাকার কারণে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এবং ভোটের কাজে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা সুষ্ঠু ভোটের জন্য সহায়ক ছিল না। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, এটি সত্য যে বিগত সময়ে বেশ কয়েজন নির্বাচনী কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছিলেন। তারপরও আমাদের তাদের ওপর আস্থা রাখতে হবে। কেননা নির্বাচনী দায়িত্বের জন্য তাদের বিকল্প নেই আমাদের কাছে।
সাধারণত একটি বুথে এক জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ইভিএম মেশিন পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। তাকে সহযোগিতার জন্য থাকেন দুই জন পোলিং অফিসার। আর ভোটকক্ষে উপস্থিত থাকেন বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্টরা। একজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, স্মার্টকার্ড বা ফিঙ্গার প্রিন্ট দ্বারা কন্ট্রোল ইউনিটে ভোটার শনাক্তের পর তিনি ভোটদানের জন্য বিবেচিত হবেন। এ সময় ভোটকক্ষের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার বা প্রভাবশালী প্রার্থীর এজেন্ট অনেক ক্ষেত্রে জোরপূর্বক গোপনকক্ষে স্থাপিত ব্যালট ইউনিটে পছন্দের প্রতীকে কনফার্ম বাটনে চাপ দেওয়ার উদাহরণ আছে। সেক্ষত্রে প্রকৃত ভোটারকে ভোটদান থেকে বিরত থেকেই ফিরে আসতে হবে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে ইভিএমে আঙুলের ছাপ না মিললে এক শতাংশ ভোটারকে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা পাবেন সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা। এটিও অপব্যবহারের প্রবল আশঙ্কা আছে।
কেন্দ্রে প্রার্থীর এজেন্ট থাকলে অনিয়ম বন্ধ হবে : ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইভিএম ব্যবহারের নির্বাচনী অনিয়ম অনেকাংশেই দূর করা সম্ভব। কারণ সব প্রার্থীর এজেন্ট কেন্দ্রে থাকলে ইভিএমে অনিয়ম বা কারচুপির আশ্রয় নেওয়া সহজ হবে না। তবে যন্ত্র পরিচালনায় যারা থাকবেন তাদের আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ভোটে সব দলের প্রার্থী এজেন্ট দেবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী আরো বলেন, নির্বাচন তুলে আনতে কমিশনকে অনেকের ওপর নির্ভর করতে হয়। যারা সবাই কমিশনের নিজস্ব জনবল নয়। কেন্দ্রে সব প্রার্থীর এজেন্ট থাকলে ভোটে অনেকাংশ অনিয়ম দূর হবে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকার দুই সিটিতে ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভোট হবে। দুই সিটির আড়াই হাজার কেন্দ্রে ৩৫ হাজার ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রতিকেন্দ্রে সশস্ত্র বাহিনীর দুই জন সদস্য ইভিএম ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবেন। বিগত কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশন এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের চালু করা ম্যানুয়াল ইভিএম বাতিল করে নিজেরাই ফিংগার প্রিন্টযুক্ত ইভিএম উদ্ভাবন করে। বর্তমান হুদা কমিশন ইভিএম ক্রয় সংক্রান্ত ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। ঐ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়েছে।
ইত্তেফাক/এএম