ড. শামসুল আলম
বাজেট ২০২০-২১ নিয়ে এন্তার আলোচনা শুনেছি, হয়তো দুঃসময়ের বাজেট বলেই। এমনিতেই এক বছরি বাজেট নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়ে থাকে। পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ফেসবুক, অনলাইন পত্রিকায় বাজেট ঘোষণার আগে থেকে, কেমন বাজেট হওয়া উচিত, কোথায় কোথায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, কোথায় ভর্তুকি দিতে হবে, কোথায় কমাতে-বাড়াতে হবে কর, বাজেট পেশের মূলত এক মাস আগে থেকে দাবিদাওয়া এবং অর্থনীতিবিদদের প্রস্তাব আসতে থাকে। বাজেট ঘোষিত হলে পর বাজেটের আকার নিয়ে, ঘাটতির পরিমাণ নিয়ে, প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে, বরাদ্দের কমতি নিয়ে, বাস্তবায়নের অদক্ষতা নিয়ে স্বনামখ্যাত এবং এমনকি পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই বাজেট মৌসুমে বক্তব্য প্রদানে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। নিয়মিত কলামিস্ট ছাড়াও প্রধানত উঠতি মধ্যবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, অধ্যাপক, বিভিন্ন সমিতি এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শ্রেণিভুক্ত সব সরব আলোচকদের মুখরতা আমাদের সমাজগতিশীলতার ইতিবাচক নিদর্শন। এবার খুব বড় বাজেট হয়েছে কেউ কেউ বললেও বাজেটটি ২০১৫-১৬-এর পর বৃদ্ধির দিক থেকে আকারে সবচেয়ে ছোট বাজেট হয়েছে। ২০১৫-১৬ বর্ষে বাজেট আগের বছরের চেয়ে বেড়ে ছিল ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ, ২০১৬-১৭তে ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ, ২০১৭-১৮তে ১৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, পরের দুই অর্থবছরে যথাক্রমে ১৬ ও ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এবার বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। কাজেই বিশাল বাজেট বলার বস্তুনিষ্ঠতা নেই। এ বছরের মোট বাজেট আকার ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেতন, ভাতা ভর্তুকি, প্রণোদনা ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ১১ দশমিক ১ শতাংশ (দেশজ আয়ের) এবং উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ (দেশজ আয়ের)। বেতন ভাতা, ভর্তুকি-প্রণোদনা এসব ১০০ ভাগ ব্যয় হয়ে থাকে (কখনো কিছুটা বেশিও ব্যয় হয়ে থাকে)। বাজেট বাস্তবায়নের বাকি অংশ উন্নয়ন ব্যয়, যা বিগত কয়েক স্বাভাবিক বছরে দেখেছি ৯২ শতাংশ থেকে ৯৬ শতাংশ (সংশোধিত উন্নয়ন বাজেটের) ব্যয়িত হয়ে থাকে। মানে মূল বাজেটের ১৫-১৮ শতাংশ বাস্তবায়িত হয় না। মূল বাজেটের ৮২-৮৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়। মূলত বাজেট ব্যয়ের সফলতা নির্ভর করে উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন সফলতার ওপর। উন্নয়ন বাজেটের ১০০ ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে, এমন উদাহরণ বিরল, সে সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন কিংবা গণতান্ত্রিক শাসনকাল হোক না কেন। কাজেই বাজেট বাস্তবায়ন হবে না, এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য ইস্যু নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজেটের মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন, সময়োচিত বাস্তবায়ন, বাজেট বরাদ্দ—এই খাতে কম ঐ খাতে কম—এ বিষয়ে সরব আলোচনা শুনি। এক্ষেত্রে উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ গুরুত্বপূর্ণ, কেননা আবর্তক ব্যয় বাড়লে, বেতন, ভাতা, প্রণোদনা, থোক বরাদ্দ ইত্যাদিতে বৃদ্ধি পেলে মনে করা হয়, অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে। বাজেট আলোচনার মূল ফোকাস হতে পারে উন্নয়ন বাজেট। তবে কর আরোপ বিষয়টিও গুরুত্বপুর্ণ আলোচ্য বিষয়। এবারের বাজেটের অভিনন্দিত বিষয় হলো করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, ব্যক্তি করদাতার সম্পদে সারচার্জ আরোপ এবং করপোরেট সুদের হার কমানো।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বাজেটে উল্লিখিত হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে এই হার বেশি ধরা হয়েছে। আমরা সবাই জানি, এ বছরের বাজেট সাফল্যের প্রধান সূচক হবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে সরকার কতটা সফল, স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের সন্তুষ্টি আর উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে মানসম্মত ব্যয় ও সময়ানুযায়ী কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় সেটা এবং ‘মানবিক লকডাউন’ (বাজার কার্যক্রম অব্যাহত রেখে) ও যতটা সম্ভব উত্পাদন কার্যক্রম চালু রেখে কতটা সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর করা যায়—এসবের ওপর, ঠিক প্রবৃদ্ধির হার কতটা হলো তার ওপর নয়। মনে রাখতে হবে, গত শতাব্দীর ত্রিশ-উত্তর মহামন্দার পর সমগ্র বিশ্ব সর্বব্যাপী এত বড় মন্দার কবলে আর পড়েনি। যুক্তরাষ্ট্রে দেশজ আয়ের আকার কমবে ৫ শতাংশ (নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি), চীনে জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকে জিডিপি কমেছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, জার্মানির অর্থমন্ত্রী আভাস দিয়েছেন সে দেশের জিডিপি কমবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, ইসিবি প্রেসিডেন্টের মতে ইইউতে জিডিপি হ্রাস পাবে ৫-১২ শতাংশ শতাংশ। এসবই অর্থনৈতিকভাবে পরাক্রমশালী, শক্তিশালী অবকাঠামো দেশের প্রবৃদ্ধি হবে নেতিবাচকতার প্রকাশ্য ঘোষণা। তাই এ বছর যে কোনো ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিই হবে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার সাফল্য। মে মাসের শেষাবধি এসেও আমাদের অর্থনীতির ভিত্তিটা দেখতে পেয়েছি এতটুকুও টলেনি, প্রবাসী আয় ছিল প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার, রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার, চলতি অ্যাকাউন্টে ব্যবধান কমেছে ৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে, ৯ শতাংশ সুদের হার কার্যকর হওয়া এবং ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার অর্থনীতি পুনরুজীবিত করার ১৯টি সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা, এ বছরের বর্ধিত বাজেট সাপোর্ট প্রাপ্তি, উদ্যোক্তাদের জন্য বাজেটে ১০ কোটি টাকার স্টার্ট-আপ ক্যাপিটেলের ব্যবস্থা, ভালো কৃষি উত্পাদন এবং ৯৫ হাজার কোটি টাকার সামাজিক সুরক্ষা ব্যয়ের মাধ্যমে চাহিদা বৃদ্ধি, করোনায় অক্ষত সব ভৌত অবকাঠামো, এসব মিলিয়ে ভালো প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা এখনো অমূলক নয়।
আলোচনায় এসেছে বাজেট ঘাটতি অনেক বড়, যা দেশজ আয়ের ৬ শতাংশ (টাকার অঙ্কে ১ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা)। গত দুই দশকে (২০০৫-০৬ অর্থবছর ব্যতীত) বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়নি। ২০০৫-০৬ অর্থবছরের পর এবার ঘাটতি ৬ শতাংশ বেশি নয় মোটেও। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এই ঘাটতি সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ হলেও বড় রকমের ঝুঁকি নেই মনে করি। স্বাভাবিক সময়েও ভারতে ৭ শতাংশ ঘাটতি নিয়েও বাজেট হয়েছে। তবে হ্যাঁ, রাজস্ব দেশজ আয় অনুপাত বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে, কেননা আমাদের কর-রাজস্ব অনুপাত দুনিয়ার তো বটেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও সর্বনিম্ন। বাজেট বাস্তবায়ন সাফল্যের এ বছরের জন্য এটিই একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হবে। আরো যে সমালোচনা জোরালোভাবে এসেছে তা হলো স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি খাতে বরাদ্দ কম। বরাদ্দ বাইরে থেকে বলি কম হলো। ভেতর থেকে বিষয়টা এমন যে উন্নয়ন বরাদ্দের চাহিদার চেয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নের আগে প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়কে পরিকল্পনা কমিশন থেকে পত্র দেওয়া হয়। এভাবে প্রথম আহ্বান পত্র, দ্বিতীয় আহ্বান পত্র। মন্ত্রণালয়গুলোর চাহিদা গত দুই বছরের বাস্তবায়ন ক্ষমতা বিবেচনায় রেখে প্রধানত নির্ণীত হলেও যৌক্তিক বিবেচনায় প্রকল্প প্রস্তাবের ভিত্তিতে বরাদ্দ দেওয়া চূড়ান্ত হয়ে থাকে। এক বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় ছাড়া উন্নয়ন বরাদ্দের ১০০ ভাগ ব্যয়িত হয়েছে—এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে খুব কমসংখক মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দাবি জানায়। আগেই বলেছি মন্ত্রণালয়গুলো কতটা বাস্তবায়ন করতে পারে। তবু মন্ত্রণালয়গুলো যত দাবি করে মোটামুটি তারা সে রকম বরাদ্দ পেয়ে থাকে। এমনকি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি চূড়ান্তকালীন জাতীয়
অর্থনৈতিক কাউন্সিল সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানালে সদয়ভাবে তিনি তা বিবেচনা করেন। কাজেই বরাদ্দ যেহেতু মোটামুটি চাহিদা মতোই দেওয়া হয়ে থাকে সেজন্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কম হয়েছে বলার সুযোগ কম। এবার স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাত, কৃষি খাতে মন্ত্রণালয়গুলো যা চেয়েছে তার চেয়েও বেশি দেওয়া হয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প চাহিদার পুরোটা তো মেটানো হয়েছেই, তদুপরি ১০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে (সচরাচর এমনটা দেওয়া হয় না), যদি প্রয়োজন হয় সেটাও ব্যয় করতে পারবে। এটাও বলা হয়েছে, উন্নয়ন কিংবা রাজস্ব হোক যা প্রয়োজন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হবে। পরিকল্পনা কমিশন থেকেও বলা হয়ে থাকে যে, যথাযথভাবে উন্নয়ন ব্যয় করতে পারলে বাজেট সংশোধনকালে বাজেট বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস করা যাবে। মূল সমস্যা বরাদ্দ কমবেশি নয়, ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানোই সমস্যা, সেদিকেই মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। মোটা দাগে বলা যায়, শুধু কোনো মন্ত্রণালয়েরই নয়, দেশের মোট বাজেটের আকার আরো বেশ বড় করা প্রয়োজন, ব্যাপক অবকাঠামো চাহিদা, বাজারভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি তৈরি, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, গরিবদের সুরক্ষা বাড়ানো এবং বিচার কাঠামোকে আরো শক্তিশালীরূপে গড়ে তোলার জন্য। মোটামোটি সবাই একমত যে, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যেমন সর্বতো প্রয়াস চালাতে হবে, তেমনি আমাদের দারিদ্র্য পরিস্থিতি ও ব্যাপক কর্মহীনতা বিবেচনায় ‘কঠোর লকডাউন’ বাস্তবায়ন অসম্ভব ব্যাপার। দেশব্যাপী তা হতে পারে না। হলে সাড়ে ৬ কোটি কৃষি পরিবার, পৌনে ২ কোটি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মহীন যেখানে কৃষি কর্মে দৈনন্দিন কর্ম সম্পাদন প্রয়োজন এবং কৃষি মৌলিক পণ্যাদির ওপর ১৭ কোটি ভোক্তা দৈনন্দিন নির্ভরশীল, তাদের কী হবে? উত্পাদন ও বিতরণশৃঙ্খল ব্যাহত হলে মূল্যস্ফীতি হবে আকাশছোঁয়া। তো এসব বিবেচনায় যে ‘মানবিক লকডাউন’ সরকার অনুসরণ করছে এটিই চমত্কার মডেল এবং এই মডেলেই এগুতে হবে।
বাজেটে সরকারের ১৯টি আর্থিক পুনর্জীবন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যাংকসমূহের সংশ্লিষ্টতা নাকচ করে, ‘এসডিজি বিষয়ক নাগরিক প্ল্যাটফরম’ পরামর্শ রেখেছেন—এসব কর্মসূচি স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে পারে। আমাদের দেশে ১ কোটি ১৮ লাখ অণু, ক্ষুদ্র, মাঝারি এন্টারপ্রাইজ রয়েছে। এদের সঙ্গে এবং সব ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার সঙ্গে বিনিয়োগ ও লেনদেনে ব্যাংকগুলোই জড়িত। প্রণোদনা প্যাকেজে যত সীমাবদ্ধতাই থাক ব্যাংকের বিকল্প কিংবা মাইক্রো ফাইন্যান্সের বিকল্প আর তো কেউ নেই। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা অভিজ্ঞতাহীন এসব কাজে কীভাবে সহায়তা করবে? মনে হয়, যে যেভাবে পারছি তাই পরামর্শ রাখছি, সে যত খ্যাত থিংকট্যাংকই হোক। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বাজেট পর্যালোচনায় আরেক জন খ্যাত অর্থনীতিবিদের মন্তব্য হচ্ছে, ‘এ বছরের বাজেটে একশন প্ল্যান নেই’ এবং কৃষিতে মধ্যস্বত্বভোগীরা লুটে খাচ্ছে—বাজেটে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
বাজেট সরকারের আয় ও ব্যয়ের বাত্সরিক খতিয়ান। আয়ের উত্সগুলো চিহ্নিত থাকে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে ঘাটতি বাজেট হয়ে থাকে। কোথা থেকে সে ঘাটতি মেটানো হবে, তার ব্যাখ্যা থাকে। ব্যয়ের বড় অংশ বেতন-ভাতা, ভর্তুকি—প্রায় পুরোটা আবর্তক ব্যয় হিসেবে চিহ্নিত, যা গতানুগতিক। উন্নয়ন ব্যয় নিয়ে আলোচনা বেশি সীমাবদ্ধ থাকে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অবশ্যই অ্যাকশন কর্মসূচি বাজেটে। অন্তত বিগত বছরগুলোর মধ্যে এই ১২তম বাজেট একটি ব্যতিক্রমী বাজেট এই অর্থে যে, এখানে ১৯টি সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগ কর্মসূচি সন্নিবেশিত করা হয়েছে, যা আমাদের দেশজ আয়ের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এই বিনিয়োগ ব্যয় ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, চীন এবং মালয়েশিয়ার চেয়েও বেশি। আমাদের সবচেয়ে বড় বেসরকারি খাত হচ্ছে কৃষি, যা সারাদেশ বিস্তৃত অসংখ্য উত্পাদক ভোক্তা ও প্রতিটি পর্যায়ে অগুনতি ব্যবসায়ী জড়িত। সবচেয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার হচ্ছে কৃষি মৌলিক পণ্যের বাজার। প্রায় সব কৃষি পণ্যের দরদাম চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় বাজারে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ব্যবসা করে থাকে। কৃষি মৌলিক পণ্য ব্যবসায় অত্যধিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ নেই। কৃষিপণ্য বিপণন গবেষণা দ্বারা আমার এ প্রতিপাদ্য সুপ্রতিষ্ঠিত। কৃষিপণ্য ব্যবসায় বিরাট মুনাফার সুযোগ থাকলে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যুবক এ ব্যবসায় নেমে পড়ত। মনে হয়, কৃষি বাজারব্যবস্থা সম্পর্কে অনেকের ধারণা অস্বচ্ছ।
সর্বশেষ বলতে চাই। কৃষি খাতকে সহায়তা প্রদানে এ সরকার অন্তঃপ্রাণ। এত বিশাল ভর্তুকি আর কোনো খাতে দেওয়া হয় না। নার্স (NARS)-এর ১২টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সরকার চালায়। কৃষির সব উপকরণে ব্যাপক ভর্তুকি আছে। কৃষি রপ্তানিতে ৫ শতাংশ থেকে (মত্স্য, শাকসবজি) ২০ শতাংশ (পাট ও পাটজাত পণ্য) পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হয়ে থাকে। ধান-গম ক্রয়ে মূল্য সমর্থন রয়েছে। কৃষির জন্য জেলা-উপজেলা, ওয়ার্ড পর্যন্ত সরকারি সম্প্রসারণকর্মী সরকার নিয়োজিত রেখেছে। ফুল, ফল চাষ ও বীজ উত্পাদনে এ বছর ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ রেখেছে। আর ৪ শতাংশ সুদে কৃষিভিত্তিক ব্যবসা ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা কর্মসূচিতে রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হলো—কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে, কৃষি খাতকে সচল রাখতে, বাজারশৃঙ্খল যাতে কার্যকর ও পণ্য প্রবাহ অক্ষুণ্ন থাকে তা যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। ১০০ কোটি টাকার যে উদ্যোক্তা স্টার্ট আপ বরাদ্দ বাজেটে রাখা হয়েছে—এটা কৃষিব্যবসা, পণ্য মজুতকরণ ও যান্ত্রিকীকরণ সেবাপ্রতিষ্ঠান ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে অংশ নিতে শিক্ষিত বেকার যুবকদের উত্সাহিত করতে হবে।
n লেখক :অর্থনীতিবিদ ও সামষ্টিক পরিকল্পনাবিদ