মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাংলাদেশ

আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:২২

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত বিশ্ব তাদের অর্থনৈতিক শক্তি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম জোরদার করার জন্য ব্যাপকভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করতে থাকে। গত শতাব্দীর ৭০ দশকের শেষে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ধস শুরু হলে মুক্তবাজার অর্থনীতির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। অনেকেই ভাবতে থাকেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি বোধহয় সর্বরোগ সংহারক বটিকা বিশেষ। তাই বিভিন্ন দেশ মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ শুরু করে। উন্নয়ন সহযোগীরাও সাহায্য প্রদানের আগে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণের শর্ত জুড়ে দেয়। বর্তমানে বিশ্বে এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করছে না। মুক্তবাজার অর্থনীতি যদি সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে ভোক্তারা বেশ কিছু সুবিধা অর্জন করতে পারে।

মুক্তবাজার অর্থনীতির সত্যিকারার্থে সুফল দিতে হলে পণ্য বিপণন পর্যায়ে সততা এবং দায়িত্বশীলতা খুবই প্রয়োজন; কিন্তু সব দেশ মুক্তবাজার অর্থনীতি সফল হওয়ার জন্য যেসব শর্ত অনুসরণ করা আবশ্যক, তা সঠিকভাবে পরিপালন করতে পারছে না। ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতি সব দেশে বা সব সমাজে একইভাবে সফল হতে পারছে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে উত্পাদন এবং বিপণনের অনেক বিকল্প থাকে। ফলে একজন উত্পাদক বা সরবরাহকারী চাইলেই পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করে ভোক্তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। বরং ভোক্তা তার চাহিদার পরিবর্তন এবং রূপান্তরের মাধ্যমে বাজারে একধরনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটাই অসহায়ভাবে পরিচালিত হয়। কারণ, বাজারে তাদের কোনো মনোপলি বিজনেস করার সুযোগ থাকে না। মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল কথাই হচ্ছে—‘যোগ্যতার জয়, আর অযোগ্যের বিদায়।’

বাংলাদেশ ১৯৯১ সাল থেকে অব্যাহতভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে চলেছে; কিন্তু এই দীর্ঘ প্রায় তিন দশকে আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতিকে কতটা কল্যাণমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি, সে প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে। অনেকেই বলে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং প্রয়োজনীয় নৈতিকতার ঘাটতির কারণে বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। মহল বিশেষের কারসাজির কারণে মুক্তবাজার অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। ফলে এই ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত সুফল আমরা ভোগ করতে পারছি না। রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসৃত হলেও বাজার কার্যত মহলবিশেষের প্রভাবের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই যখন তখন কোনো পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মতো ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। বাজারে সঠিক বিপণনব্যবস্থা না থাকার কারণে অধিকাংশ সময়ই উত্পাদক এবং ভোক্তার মধ্যে সরাসরি সংযোগ ঘটছে না। মধ্যস্বত্বভোগীরা উত্পাদক এবং ভোক্তার মধ্যে সংযোগসাধনের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। এতে উত্পাদক তার পণ্যের সঠিক বা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। আর ভোক্তাও তুলনামূলক কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারছে না। এই অবস্থায় উত্পাদক এবং ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা, উত্পাদনের সঙ্গে যাদের কোনোই যোগসূত্র নেই। মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল সূত্রই হচ্ছে—বাজারে একটি পণ্যের চাহিদা এবং জোগানের ওপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারিত হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সফল হতে হলে বাজারব্যবস্থায় নৈতিকতা একান্ত জরুরি। কোনো কারণেই বাজারের স্বাভাবিকতা যাতে কেউ বিপন্ন করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য উত্পাদক, ভোক্তা ও সরবরাহকারী—প্রত্যেকেরই সর্বোচ্চ নৈতিকতা আবশ্যক। আমাদের দেশে প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কোনো একটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করা হয়। কিছু দিন আগে আমরা দেখলাম পেঁয়াজের মূল্য কেজিপ্রতি ২৫০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হঠাত্ করেই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার অজুহাতে পেঁয়াজের মূল্য এভাবে বৃদ্ধি করা হয়; কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাজারে কি পেঁয়াজ ছিল না? প্রতিবেশী দেশ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেও বাজারে তার প্রভাব পড়তে বেশ কিছু দিন সময়ের প্রয়োজন ছিল। কারণ, ইতিপূর্বে আমদানিকৃত এবং স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত পেঁয়াজ তো গুদামে ছিল। ব্যবসায়ীরা এ ক্ষেত্রে নৈতিকতার পরিচয় দিতে পারেননি। বরং তারা এই সুযোগে জনগণের চাহিদাকে জিম্মি করে অস্বাভাবিক মুনাফা লুটে নেয়। বর্তমানে আলুর মূল্য কেজিপ্রতি ৫০ টাকায় উন্নীত হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ তো আলু আমদানি করে না। গত মৌসুমে দেশে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। তাহলে আলুর এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী? সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, সরকার বাজার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি নয়। আমরাও চাই না সরকার কারো কাছে জিম্মি হোক। তাহলে আলুর দাম এতটা বৃদ্ধি পেল কেন? আমাদের দেশের কোনো সরকারই বাজারের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বাজার যদি তার স্বাভাবিক গতিতে পরিচালিত হতো তাহলে অন্তত আলুর মতো স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য এতটা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কথা ছিল না।

অনেকেই মনে করেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার বাজারের ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাই বাজারে কোনো একটি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পেলেও সরকারের তেমন কিছু করণীয় থাকে না—এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ফ্রি-মার্কেট অর্থ ফ্রি-স্টাইল মার্কেট নয়। কোনো কারণে বাজারে অস্বাভাবিকতা বা অস্থিরতা সৃষ্টি হলে অবশ্যই সরকার সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। মার্কেট ম্যাকানিজম যাতে সঠিকভাবে চলে তার ব্যবস্থা করা সরকারেরই দায়িত্ব। কিছু দিন পরপরই বাজারে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর নৈতিকতার অভাব। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সফল হতে হলে উন্নত নৈতিকতা খুবই দরকার। যখন কেউ স্বাভাবিক অবস্থায় নৈতিকতা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয় তখন তাকে নৈতিকতা অনুসরণে বাধ্য করা যেতে পারে। বর্তমানে দেশে করোনা সংক্রমণের কারণে মানুষের মধ্যে ভোগ-ব্যয় কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি করে তাদের মুনাফা অর্জনের দিকে মনোযোগী হতে পারে—সম্ভাব্য এই অবস্থা প্রতিরোধ করার জন্য সরকারিভাবে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। একটি পণ্য উত্পাদনের কত দিনের মধ্যে বাজারে নিয়ে আসতে হবে, তার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। যে পণ্য আমদানি করা হয়, তা বন্দর থেকে ছাড়করণের কতদিনের মধ্যে বাজারে নিয়ে আসতে হবে, তারও সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। কোনো ব্যবসায়ী যাতে পণ্য বেশি দিন গুদামজাত করে না রাখতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারে প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্যতালিকা টানিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেউ বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি করলে তার ট্রেড লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রতিটি পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য কত হবে, তা সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিভাগকে আরো শক্তিশালী করে বাজারে কার্যকর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পণ্যের গুণমান যাতে ঠিক থাকে, তার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কেউ নিম্নমানের বা নকল পণ্য বিক্রি করে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে না পারে। বিভিন্ন ধর্মীয় উত্সবের সময় পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের চেষ্টা না করেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম যাতে সঠিকভাবে পরিপালিত হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক :অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক

ইত্তেফাক/টিআর