বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন ছায়া-সুশীতল প্রকৃতির শান্ত সুন্দর নদী আবহে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য ও যৌবনের বিকাশ তার নদীর উদ্দাম স্রোতে, গভীর কলতান আর মাঝিমাল্লার গান শুনে শুনে। বাইগার ও মধুমতী নদী বঙ্গবন্ধুর অন্তরঙ্গ বাল্যসখা। একজন শিশু যে সিংহহূদয়ের মানুষে পরিণত হলেন, স্বাধীনতার ডাক দিলেন, মুক্তির গান গাইলেন এবং জাতির পিতা হিসেবে অভিহিত হলেন। সেই শক্তির অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছেন হীরার কুচির মতো দীপ্তি ছড়ানো তার স্বদেশ, দুঃখী মানুষের হাহাকার আর নদীর প্রবহমানতা থেকে। কী গভীর অন্তর্দৃষ্টি, অনির্বচনীয় অনুভব আর অদম্য ভালোবাসার অঙ্গীকার থাকলে কেবল এই শক্তি অর্জন করা যায় তা অনুধাবন করাও কঠিন। মনোভূমির অফুরন্ত শক্তি, প্রেরণা যা বাইগার, মধুমতী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কীর্তনখোলা, কর্ণফুলী, সুরমাকে দেখে দেখে এবং ভালোবেসে ভালোবেসে পেয়েছেন তা তাকে মহামানবে পরিণত করেছে।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের পঙিক্ততে একই কথা শুনি:
‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
বঙ্গবন্ধু মধুমতী, রূপসা হয়ে গোপালগঞ্জ থেকে খুলনা, কলকাতা গেছেন এবং ফিরে এসেছেন। নৌপথের এ রকম যাত্রায় তিনি একবার কলকাতা থেকে খুলনা হয়ে গোপালগঞ্জে আসছিলেন। তখন খাদ্যসংকটের মুখোমুখি ঢাকা, কুমিল্লা ও ফরিদপুরের জনগণ। সরকার কর্ডন প্রথা চালু করেছিল অর্থাত্ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কোনো খাদ্য যেতে দেওয়া হতো না। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক, খুলনা ও বরিশালে ধান কাটবার মৌসুমে দল বেঁধে দিনমজুর হিসেবে যেত। এরা ধান কেটে ঘরে উঠিয়ে দিত, পরিবর্তে একটা অংশ পেত। এদের ‘দাওয়াল’ বলা হতো। এরা যখন কাজ শেষে বাড়ি ফিরত তখন সরকার তাদের খাদ্য আটকিয়ে দেয়। অন্যদিকে এদের পরিবার অভুক্ত, এই অবস্থায় তরুণ বঙ্গবন্ধু দিশেহারা দাওয়ালদের এই নালিশ শুনে ছুটলেন জেলা ম্যাজিট্রেটসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এবং দেনদরবার শুরু করলেন। (আলোচ্য ঘটনার তথ্য সূত্র :অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা : ১০৩ ও ১০৪)
নৌপথের এ রকম বহু উজ্জ্বল স্মৃতি লাল নীল দীপাবলি ছড়িয়েছে। একজন রাজনৈতিক নেতার মনোভূমি তৈরির শিক্ষা তিনি অর্জন করেছেন সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণা থেকে।
অসাধারণ আরেকটি বর্ণনা ও অনুপম অনুভব আমরা পাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগরে নৌপথ যাত্রায়। ঐখানের বাসিন্দা জনাব রফিকুল হোসেন কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের দ্বারোদ্ঘাটনে এক সভার আয়োজন করেন। বঙ্গবন্ধুসহ অনেকেই আমন্ত্রিত। জনাব এন এম খান সিএসপি, ডিজি, ফুড ডিপার্টমেন্ট আমন্ত্রিত ছিলেন। বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, সোহরাব হোসেন ও বেদার উদ্দিন আহমেদ ঐ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে সংগীত পরিবেশন করেন।
(অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পৃষ্ঠা : ১১১-তে এ সম্পর্কে অনবদ্য একটি বর্ণনা বঙ্গবন্ধুর জবানিতে আসুন শুনি)
‘পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম, আশুগঞ্জ স্ট্রেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন তার গান শুনছে। তারই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তার নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।’
তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’
আরো এ রকম অনেক ঘটনা নদী ও নৌযাত্রাকে কেন্দ্র করে। আরেকটি ঘটনার বিবরণ অসমাপ্ত আত্মজীবনের (পৃষ্ঠা :১২৫-এ বঙ্গবন্ধুর জবানিতে শোনা যাক)
‘আমরা দুইজন রাত দশটায় একটা এক মাঝির নৌকায় রওয়ানা করলাম। নৌকা ছোট্ট, একজন মাঝি। মধুমতি দিয়ে রওয়ানা করলাম। কারণ, তাঁর (মাওলানা শামসুল হক) বাড়ি মধুমতির পাড়ে। মধুমতির একদিকে ফরিদপুর, অন্যদিকে যশোর ও খুলনা জেলা। নদীটি এক জায়গায় খুব চওড়া। মাঝে মাঝে, সেই জায়গায় ডাকাতি হয়, আমাদের জানা ছিল। ঠিক যখন আমাদের নৌকা সেই জায়গায় এসে হাজির হয়েছিল আমি তখন ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পানির দেশের মানুষ নৌকায় ঘুমাতে কোন কষ্ট হয় না। কাজী সাহেব তখনও ঘুমান নাই। এই সময় একটা ছিপ নৌকা আমাদের নৌকার কাছে এসে হাজির হল। চারজন লোক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করল, আগুন আছে কি না? আগুন চেয়েই এই ডাকাতরা নৌকার কাছে আসে, এই তাদের পন্থা। আমাদের নৌকার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “নৌকা যাবে কোথায়?” মাঝি বলল, টুঙ্গিপাড়া, আমার গ্রামের নাম। নৌকায় কে? মাঝি আমার নাম বলল। ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে ভীষণভাবে একটা আঘাত করে বলল, “শালা আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়”। এই কথা বলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেল।’
কেন জাতীয় ফুল শাপলাকে করা হয়েছে। মনে মনে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি দীর্ঘদিন। বঙ্গবন্ধু শাপলাকে জাতীয় ফুল করেছিলেন। টুঙ্গিপাড়ার বর্ণি বাঁওড়ের লাখ লাখ শুভ্র সমুজ্জ্বল শাপলা ফোটা দেখে এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। নদীর সঙ্গেই বিল, বাঁওড় ও হাওরের সম্পর্ক। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে করচার হাওরে ভোরের বাতাসে ফোটা লাখো সাদা শাপলা দেখেও মনে হয়েছে শাপলারই হওয়া উচিত জাতীয় ফুল।
আমরা কথায় কথায় বলি নদীমাতৃক বাংলাদেশ। পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার অববাহিকায় হিমবাহ গলা পলিমাটি দিয়ে গঠিত আমাদের মাতৃভূমি। নদী মায়ের মতো। জন্মভূমি জননীর মতো পবিত্র। নদী নারীর মতো কথা কয়। মায়ের মতো কথা কয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার ঘষিয়াখালী থেকে রামপালের বেতবুনিয়া হয়ে মোংলা নদীর মুখ পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার কৃত্রিম নদী পথের সৃষ্টি করেন, যা সুন্দরবন রক্ষায় ভূমিকা রাখে। ঐ চ্যানেলটি মরে যাওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে চ্যালেনটি পুনঃখনন করে চালু করা হয়। খননের পর ২১/৯/২০২০ পর্যন্ত ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮২৬টি নৌযান চলাচল করেছে তার মধ্যে ১০-১২ ফুট ড্রাফটের ৮২ হাজার ৬৬৯টি বড় জাহাজ এবং ৮ ফুট ড্রাফটের ৭৬ হাজার ১৫৭টি জাহাজ। ঐ খনন কাজে বিভাগীয় কমিশনার খুলনা হিসেবে আমাকে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি ৪০ বার খনন কাজ পরিদর্শন করি এবং প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করি। ফলে এখন কোনো জাহাজ শ্যালা নদী ব্যবহার করে না। সুন্দরবন সুরক্ষায় এই উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
আমাদের নদী ও নদীপথ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিশেষ সমৃদ্ধ, বেগমান এবং পরিবেশবান্ধব হয়েছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবন নদী ও নদীপথের বিকাশে সম্পূর্ণ অভিন্ন সত্তায় বিকশিত জীবনের আলোকোজ্জ্বল প্রতীক।
লেখক: কবি ও গদ্যকার, সিনিয়র সচিব (পিআরএল), নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়
ইত্তেফাক/কেকে