যার হাত ধরে বাংলাদেশে নতুন ধারায় ভিডিও তৈরি শুরু হয়েছে তিনি হলেন এনায়েত চৌধুরী। সকলের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেছেন বিশ্লেষণধর্মী ভিডিও তৈরি করে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিতর্ক করা শুরু করেন এনায়েত চৌধুরী। তখন থেকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ঘটনাবলী জানার আগ্রহ বাড়ে তার। প্রচুর পত্রিকা পড়তেন ছোটবেলা থেকেই। এমনও হয়েছে পত্রিকা পড়ায় বেশি মনোযোগ দিয়ে আবার আসল পড়াশোনায় যেন ঝামেলা করে না ফেলেন সেজন্য বাসায় পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার পর খিলগাঁও থেকে বাসায় আসার রিকশা ভাড়া ১৫ টাকা বাঁচিয়ে ৮ টাকার পত্রিকা ও ২ টাকার পাইপ আইসক্রিম কিনে খাওয়ার স্মৃতি রয়েছে তার শৈশবে।
এনায়েত চৌধুরীর স্কুলজীবন কেটেছে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে নটর ডেম কলেজ থেকে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) সমপন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে পোস্টার প্রতিযোগিতা, ব্যবসা সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা ছাড়াও সৃজনশীল নানা কাজে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করতেন বিতর্ক ও পড়াশোনার পাশাপাশি। এমনকি ক্লাসের বাত্সরিক অনুষ্ঠান আয়োজন, নবীনবরণ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা, এমনকি বিভাগের ভেতরে একটা ছোটখাটো ক্রিকেট টুর্নামেন্টও আয়োজনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকতেন তিনি।
২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে অধ্যয়নকালে এনায়েত চৌধুরী শিক্ষকতা শুরু করেন। ৪ বছরের অধিক সময় উদ্ভাসে, অন্যরকম পাঠশালায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেছেন। বাংলাদেশি ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম টেন মিনিট স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন এনায়েত চৌধুরী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা শুরু করেন ২০১৯ সালে আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটে প্রভাষক হিসেবে যুক্ত হন। এই যাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলে এনায়েত চৌধুরী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া বেশ কঠিন একটা কাজ। ইউটিউবে এক লাখ সাবস্ক্রাইবার পাওয়ার তুলনায় প্রায় ১০ গুণ কঠিন কাজ। প্রথম বর্ষে প্রথম সেমিস্টারের ফলাফলটা অপ্রত্যাশিতভাবে বেশ ভালো হয়ে যায়। এরপর থেকেই পরিকল্পনা আসে যেভাবেই হোক এটা ধরে রাখতে হবে। দ্বিতীয় বর্ষে কিছুটা খারাপ করি। তৃতীয় বর্ষের শুরুতে বিতর্ক ছাড়ার এটাও একটা কারণ; অনেক সময় খেয়ে ফেলতো। তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের একটা সেমিস্টার বাদে ফলাফল বেশ ভালো আসে এবং নিজের বিভাগে অবস্থান বেশ উপরে থাকে। এর ফলেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে পারা। নতুন ধারায় ভিডিও তৈরি করছেন এনায়েত চৌধুরী। এই ধারায় ভিডিও তৈরির পরিকল্পনা এলো কীভাবে—জানতে চাইলে তিনি জানান, যদি শিক্ষা ও বিনোদনকে একসঙ্গে করে সফলতার ভিত্তিতে বিবেচনা করেন তাহলে দাবিটি মিথ্যে নয়। আগেই বলেছি আমি অনেক আগে থেকেই ইউটিউবের একজন নিয়মিত দর্শক। একদিন মনে হলো আমরা যে সবসময় বলি বাংলাদেশে ভালো কন্টেন্ট ক্রিয়েটর সংখ্যায় খুবই কম, এর সমাধান কী? পরীক্ষামূলকভাবে নিজেই ইউটিউবে ভিডিও বানানো শুরু করে দেই, দেখার জন্য মানুষ এরকম নতুন একটি জিনিসে কতটা সাড়া দেয়, এটাও একটি গবেষণার অংশ বলা যায়। আমি ভেবেছিলাম এরকম গুরুগম্ভীর বিষয় বিশ্লেষণে মানুষ ততটা আগ্রহ দেখাবে না। আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমরা অনেক সময়ই ভালো কন্টেন্ট না আসার পেছনে ভালো ইউটিউব বা ফেসবুক দর্শক না থাকাকে দায়ী করি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, ভালো কন্টেন্ট ক্রিয়েটর না আসাও ভালো দর্শক তৈরি না হওয়ার একটি বিশেষ কারণ।
এনায়েত চৌধুরী দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালে বিভাগীয় শিক্ষক আজিজুল ইসলামের সঙ্গে কিছু কাজ করার সুযোগ পান। তিনিই মূলত শুরুতে ধরিয়ে দেন গবেষণাপত্র কী, গবেষণা কীভাবে শুরু করতে হয়, এটা কেন জরুরি? সেখান থেকে রিসার্চের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় এনায়েত চৌধুরীর। একসময় রিসার্চার হয়ে ওঠা। এনায়েত চৌধুরীর প্রতিটি ভিডিও অনেক বেশি তথ্যবহুল। প্রতিটি ভিডিও তৈরি করতে সময় লাগে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা। তার সঙ্গে দুজন গবেষণা সহকারী, একজন থাম্বনেইল সমপাদক ও একজন ভিডিও সমপাদক কাজ করেন।
তিনি জানান, ভিডিও সমপাদনার কাজ আমি নিজেই করি বেশির ভাগ অংশে। কাজটা ৩ ভাগে বিভক্ত। যেমন, ১. গবেষণা- কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা, প্রথমে সাধারণ গুগল সার্চ দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও বিশ্লেষণ যাচাই করা হয়। তারপর গুগল স্কলার ও রিসার্চগেট ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র নিয়ে কাজ করা হয়। সবশেষে যেসব তথ্য পেলাম সেগুলো গুগল ও ফেসবুকের বিভিন্ন সোর্সের সঙ্গে ক্রস-চেক করে যাচাই করা হয়, পরে সেগুলোকে সহজবোধ্য করে স্ক্রিপ্টে টুকে ফেলা হয়। ২. ভিডিও ও অডিও ধারণ করতে হয় কমপক্ষে ১ ঘণ্টা। ৩. ভিডিও সমপাদনা করতে হয় কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা। এভাবেই একটা কনটেন্ট সকলের সামনে উপস্থাপন করা হয়। ২০২০ সালে এনায়েত চৌধুরী লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। লেখালেখির ঝোঁক বেশ আগে থেকেই। তবে বই প্রকাশের ইচ্ছা জাগে বুয়েটে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর। তখনও ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি শুরু করেননি তিনি। আমাদের দেশে প্রকৌশল নিয়ে লেখালেখি খুব কম হয়। তিনি ভাবলেন, এই দিকটায় বাংলা বই বেশ জরুরি। তাই প্রথম বই লিখলেন পদ্মা সেতুর গাঠনিক দিক নিয়ে। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বইটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকা লিখেন। নতুন একটি বইয়ের কাজ প্রায় ২ বছর ধরে চলছে বলে জানান এনায়েত চৌধুরী। তিনি মূলত সাধারণ মানুষের কাছে পুরকৌশলকে জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্য নিয়েই লিখে চলেছেন। তার ইউটিউব চ্যানেল এক লাখ মানুষ যুক্ত রয়েছেন এবং ফেসবুক পেজে রয়েছে দুই লাখের অধিক অনুসারী। ইউটিউব চ্যানেলে রয়েছে ৭০’র অধিক ভিডিও। প্রায় ৩ কোটিবার দেখা হয়েছে ভিডিওগুলো।
তিনি বলেন, ‘দেশের তরুণ সমাজকে চিন্তাধারার দিক থেকে শক্তিশালী করতে চাই, যেন তারা পরমতসহিষ্ণু হয়।
ইত্তেফাক/জেডএইচডি