শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সকলের জন্যই ইহা অশনিসংকেত স্বরূপ

আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২১, ১৮:১৩

একটি দেশের উন্নয়ন ও সুশাসনের জন্য প্রশাসনের কমকর্তা ও কর্মচারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সরকার তাহাদের মাধ্যমেই নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করিয়া থাকে; দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে নহে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই সকল কার্য সম্পাদনের বিষয়টি উন্নয়নশীল বিশ্বে পদে পদে হোঁচট খায়। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়—প্রশাসনের কর্মীরা রাজনীতিকদের হুকুমের গোলামে পরিণত হইয়া পড়ে।

বলিবার অপেক্ষা রাখে না, এই সমস্যা নির্দিষ্ট কোনো দেশের নহে, ইহা উন্নয়নশীল বিশ্বের সাধারণ রোগ। এই ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের নিকটবর্তী রাজ্যের কিছু ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টি অনুধাবন করা আরো সহজ হইবে। কিছুদিন পূর্বে সেই রাজ্যে দীর্ঘ সময় ধরিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইল, সেই সময় আমরা হতবিহ্বল হইয়া দেখিয়াছি সহিংসতা কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী। ঐ রাজ্যের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সূত্র ধরিয়াই বলা যায়, রাজ্যের ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে অন্যপক্ষ অভিযোগ করিয়া বলিয়াছে, রাজ্যের পুলিশ এবং প্রশাসন পুরোপুরি রাজনীতির দখলে চলিয়া গিয়াছে। সেইখানে কেবল নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়াই রাজনৈতিক সহিংসতায় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে ৫১টি হত্যার কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। আবার রাজ্যের শাসক দল বলিতেছে, ভোটের পূর্বে প্রশাসন যখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ছিল, তখনই শুধু সহিংসতা হইয়াছিল।

সেইখানকার গণমাধ্যমেও বলা হইয়াছে, ইহা শুধু নিকটবর্তী রাজ্যেরই সমস্যা নহে, দেশটির অন্যান্য রাজ্যেও একই ঘটনা ঘটিয়া থাকে। এমনকি অতীতের শাসকরা একই স্টাইলে পুলিশ-প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করিয়াছিল। এই জন্য বিশিষ্ট জনেরা সকল সময়ই মনে করেন, প্রশাসন যখন দলতন্ত্রের বশ হইয়া পড়ে, তখন দলীয় অনাচার প্রশাসনকেও বিপন্ন করিয়া থাকে। ইহা ঠিক যে, সমস্ত বিপন্নতা সর্বদা একসঙ্গে প্রকাশ পায় না। যদিও তাহার নানা লক্ষণ ছাইচাপা আগুনের মতো নানান উপলক্ষ্যে প্রকাশ পাইয়াই যায়। উন্নয়নশীল বিশ্বে এই রোগ কমবেশি সর্বত্র দৃশ্যমান। অনেকে মনে করেন, রাজনীতিক ও প্রশাসন একে-অন্যকে অন্যায় সুযোগ দেন মূলত স্ব স্ব উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। এই ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই উভয় পক্ষ দ্বারা লাভবান হইয়া থাকে। ক্ষতি যাহাদের হয়, তাহারা দেশের সাধারণ জনগণ। তাহারাই দেশের মালিক, অথচ সিস্টেমের কাছে ধরা খাইতেছে।

কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বে রাজনীতিতে ও প্রশাসনে কেন জনসেবা ও সুশাসনের ঘাটতি দেখা যাইতেছে? ইহার কারণ হিসাবে বলা হইয়া থাকে, যোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে না বসাইলে কিংবা অযোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে বসাইবার ব্যবস্থা করিলে যাহা ঘটিবার তাহাই ঘটিতেছে। মনে রাখিতে হইবে, রাজনীতির মাঠ সকলের জন্য উন্মুক্ত হইলে কিন্তু প্রশাসনে চাহিলেই যে কেহ প্রবেশ করিতে পারেন না। প্রশাসনের কর্মী হইতে হইলে যোগ্যতা ও নিয়োগবিধির ভিতর দিয়া যাইতেই হইবে। এই জন্য সুষ্ঠু ও সত্ভাবে প্রশাসন পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত আইন ও বিধি রহিয়াছে। কিন্তু সমস্যাটি ঘটে আইনের প্রয়োগ লইয়া। প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি দেখেন আইনের প্রয়োগ করিতে গেলে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হইতেছেন এবং তাহাতে তাহাদের কোনো লাভ হইতেছে না, বরং বাঁকা পথে চলিলেই অধিক লাভ, তখন তো তাহারা অনিয়মের পথেই হাঁটিবেন। অথচ প্রশাসনের নিরপেক্ষকরণ বিষয়টির উপর জোর দেওয়াই হইয়াছিল রাজনীতিবিদরা যাহাতে যথেচ্ছাচার করিতে না পারেন।

আমরা মনে করি, উন্নয়নশীল বিশ্বকে এই প্রাকটিস হইতে বাহির হইতে হইবে। রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রশাসনকে অনিয়ম ও দুরাচার হইতে মুক্ত হইতে হইবে। তত্ত্বীয়ভাবে প্রথম শর্ত হইল, প্রশাসনকে দলীয় প্রভাব হইতে মুক্ত করা। সমস্যা হইল, তত্ত্ব ও বাস্তবতা এক নহে। দলের সংস্কার না করিয়া সেই বিশৃঙ্খল দল কী করিয়া প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করিবার পদক্ষেপ লইবে? সমস্যাটি ভাইস-ভার্সা। এই জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বে অপার সম্ভাবনা সকল সময় শত ফুল হইয়া ফুটিতে পারে না। কিন্তু শত ফুল না ফুটিলে সুন্দর বাগান কী করিয়া হইবে? ইহার ব্যর্থতা কি সর্বাগ্রে ঐ বাগানের মালির নহে? আর এই সকল কারণেই উন্নয়নশীল বিশ্বে নির্মম পরিবর্তন দেখা যায়। সেই পরিবর্তন ইতিহাসকে ভাঙিয়াচুরিয়া ফেলে। দেশ ও মানুষ সকলের জন্যই ইহা অশুভ পরিণতি ডাকিয়া আনিতে পারে।

ইত্তেফাক/এসআই