শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ক্ষমতার সূর্য চিরকাল মধ্যগগনে থাকে না

আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২১, ২০:৫৭

বিশ্বজগতে বাড়াবাড়ির স্থান নাই। জগতের সকল কিছুর ভিতরেই রহিয়াছে এক আশ্চর্য ভারসাম্য। ইহাই শৃঙ্খলা, ইহাই নিয়ম, ইহাই প্রকৃতির আইন। রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিতরেও এই শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা রহিয়াছে। বিশেষ করিয়া, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ থাকাটাই দস্তুর। তাহারা ন্যায়পরায়ণ, আইনানুগ থাকিবেন বলিয়াই তাহাদের স্থায়ী কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একেক সময় একেকটি দল নির্বাচনে জয়লাভ করিয়া সরকার গঠন করিবে, কিন্তু প্রশাসন সকল ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ থাকিবে। কারণ, যখন যেই দল ক্ষমতায় আসিবে তখন সেই সরকারের অধীনেই প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী চলিয়া আসিবে। সুতরাং প্রশাসনের কর্মকর্তা, আমলাদের নিরপেক্ষ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। ইহাতে একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স তৈরি হয়। যেই জন্য সংসদে তর্কবিতর্কের মাধ্যমে বোঝাপড়া হইয়া থাকে, যেই কারণে বিরোধী দল থাকে, সেই একই কারণে প্রশাসনের কর্মকর্তা, আমলাদেরও কখনোই সরকারের তল্পিবাহক হওয়া যাইবে না। 

কিন্তু  উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো কোনো দেশে ইহার ব্যত্যয় ঘটিতে দেখা যায়। দেখা যায় যে, সেইখানে সংসদে তর্কবিতর্ক একপেশে, নামকাওয়াস্তে বিরোধী দল আর প্রশাসনের কর্মকর্তা-আমলারা সরকারের অন্ধ আজ্ঞাবাহকে পরিণত হইয়াছে। প্রশাসনের মানুষদের দুর্নীতির দোসর বানাইয়া ফাঁদে ফেলা হয়। তখন তাহারা নিজেদের প্রয়োজনেই স্বেচ্ছাচারী সরকারের তল্পিবাহক হইয়া পড়েন। কিন্তু ইহাতে প্রশাসনের কর্মকর্তা-আমলাদের নিরপেক্ষ থাকিবার ও রাখিবার প্রধান উদ্দেশ্যই তখন ব্যাহত হয়। তাহারা যখন একটি নির্দিষ্ট দলের স্বার্থরক্ষায় নিজেদের ব্যাপৃত করেন, তখন সেই রাষ্ট্রে নানান ধরনের বিশৃঙ্খলা ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হইতে থাকে। জীবাণুমুক্ত পানি যেমন শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করিয়া থাকে, তেমনি করিয়া পানি যখন দূষিত হইয়া পড়ে তখন তাহা শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করিবার পরিবর্তে শরীরের জন্য নিজেই বিষাক্ত পদার্থে পরিণত হয়। এইভাবে প্রশাসনের কর্মকর্তা-আমলারাও দুর্নীতিতে দূষিত হইয়া পড়িলে তাহারা রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরীণ খারাপ বিষয় দূর করিবার পরিবর্তে দূষিত পানির মতো নিজেরাই ক্ষতিকর হইয়া পড়ে। ইহার বিপদ ভয়াবহ হয়।

ইতিহাসেই দেখা যায়, যাহারা সকল কিছু নিজের নিকট কুক্ষিগত করিতে চাহেন, তাহাদের অবস্থা শেষাবধি পরিহাসে পরিণত হয়। দশকের পর দশক ধরিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যাহারা ক্ষমতা ছিলেন, তাহাদের যখন পতন হয় দেখা যায় যে—উহার নেপথ্যে রহিয়াছে তাহাদেরই তথাকথিত বিশ্বস্ত লোক। ইহাও সত্য যে, একটি সময় পর্যন্ত সকল কিছুই তাহাদের কুক্ষিগত ছিল। এককভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কয়েক দশক ধরিয়া তাহারা ক্ষমতায় থাকিয়া সাময়িকভাবে লাভবানও হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু পতনের পর তাহাদের পরিণতি হয় তাসের ঘরের মতো।

সুতরাং সকল কিছু কুক্ষিগত করিবার সুদূরপ্রসারী এই প্রতিক্রিয়া উপেক্ষণীয় নহে। এই উদাহরণের শেষ নাই। নিকট প্রতিবেশীর ঘরেও এই উদাহরণ রহিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বত্সরের বাম-জামানার সেইখানে বিন্দু হইতে সিন্ধু অবধি সকল কিছুর মধ্যে কেবল কাস্তেহাতুড়ি ও লালরং দেখা যাইত। লক্ষ লক্ষ পিপীলিকার স্রোতের মতো চারিদিকে ছিল কেবল তাহাদেরই কর্মী। কিন্তু যখন তাহাদের পতন ঘটিল, তাহার কয়েক বত্সর পর দেখা গেল, পতনের এপিটাফে প্রদীপ দেওয়ার মতো সামান্য কর্মীও নাই। কোথায় গেল সেই লক্ষ লক্ষ কর্মীর বাঁধভাঙা স্রোত? আড়াই বত্সর আগে আমরা লিখিয়াছিলাম, ৩০ বত্সর পর ক্ষমতা অস্তাচলে সুদানের বশির। প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির তো ১৯৮৯ সালে ক্ষমতা দখল করিয়াছিলেন সেনাছাউনি হইতেই একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়া। কাহারো ক্ষমতার সূর্য চিরকাল যে মধ্যগগনে থাকে না, ২০১৯ সালের এপ্রিলে তাহারই আরো একটি দুঃখজনক উদাহরণ তৈরি করিল সুদান। অতঃপর গত ২৫ অক্টোবর সুদানে পুনরায় সরকার পতন ঘটিয়াছে। এই সকল ঘটনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুঃখজনক। 

নবিজি (স.) বলিয়াছেন যে, আল্লাহ তাহার কোনো বান্দাকে যদি মানুষের জন্য দায়িত্বশীল হিসাবে নিযুক্ত করেন, অতঃপর সেই ব্যক্তি যদি তাহার উপর অর্পিত দায়িত্ব খেয়ানত করিয়া মৃত্যুবরণ করেন, তাহা হইলে তাহার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করিয়া দেন। কেবল শাসকই নহেন, বরং যে কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্যই এই হুকুম প্রযোজ্য। উন্নয়নশীল বিশ্বকে ধর্ম ও ইতিহাস হইতে শিক্ষা লইতে হইবে। 

ইত্তেফাক/জেডএইচডি