বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বৈশ্বিক অস্থিরতায় নষ্ট হইতেছে তারুণ্যশক্তি

আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৩১

গত দেড় বত্সর কিংবা তাহারো অধিক সময় ধরিয়া করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত সমগ্র বিশ্ব। এই মহামারি সারা বিশ্বের জীবনব্যবস্থা, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়া করাইয়াছে। একদিকে মহামারির প্রত্যক্ষ প্রভাবে টালমাটাল সমগ্র বিশ্ব, অন্যদিকে ইহার পরোক্ষ প্রভাবে যেই সকল নূতন নূতন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ আবির্ভূত হইতেছে তাহা জনজীবনকে আরো অস্থির করিয়া তুলিতেছে। 

এই অস্থিরতার কারণে সামগ্রিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পড়িয়াছে নেতিবাচক প্রভাব। বলা হইতেছে করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় এবং ইহার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়া যাইবার বিষয়টি নূতন মহামারিরূপে আবির্ভূত হইয়াছে। বিশেষ করিয়া দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই যখন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়া যায় তখন তাহা সমগ্র জাতির জন্যই অশনিসংকেত হইয়া দাঁড়ায়। দেশে করোনা মহামারি শুরু হইবার পর হইতে এখন পর্যন্ত ১৪ হাজারেরও অধিক মানুষ আত্মহত্যা করিয়াছেন, ইহার মধ্যে শতকরা ৪৯ শতাংশই তরুণ-তরুণী যাহাদের বয়স ২০ হইতে ৩৫ বৎসরের মধ্যে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি বৎসর ৭ লক্ষেরও অধিক মানুষ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করিয়া থাকে। ইহার মধ্যে ৭৭ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটিয়া থাকে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে, আর আত্মহত্যার পিছনে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করিয়া থাকে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়। বিখ্যাত ফরাসি সমাজ বিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম তাহার ‘সুইসাইড’ গ্রন্থে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইয়াছিলেন, সমাজে যখন নৈরাজ্য বৃদ্ধি পায় তখন আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়িয়া যায়।

করোনা মহামারি তদ্রূপ জটিল এক নৈরাজ্যমূলক অবস্থার সৃষ্টি করিয়াছে, যাহার প্রভাব কেবল দৈহিক স্বাস্থ্যেই নহে, সামাজিক, মানসিক, আর্থিক হইতে শুরু করিয়া জীবন যাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আঘাত করিয়াছে। আর ইহার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট হতাশা, অনিশ্চয়তা আর প্রত্যাশার চাপ সামলাইতে না পারিবার কারণে সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও আত্মহত্যার মিছিল দীর্ঘায়িত হইতেছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, তরুণদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করিতে না পারা এবং চাপের মধ্যে পড়িলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িবার প্রবণতাই তাহাদের আত্মহত্যা দিকে ঠেলিয়া দেয়। 

করোনা মহামারিকালীন দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনিশ্চয়তা, হতাশা আর মানসিক চাপ আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে অবসাদের কারণে অনেক স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা পথে পা বাড়াইছে। অন্যদিকে যাহারা পড়াশোনা শেষ করিয়া চাকরিপ্রত্যাশী ছিলেন, করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ থাকায় তাহাদের মধ্যেও হতাশা বাড়িয়াছে। অনেকের চাকরির বয়স পার হইয়া গিয়াছে এই সময়, আবার চাকরি হারাইয়া বেকার হইয়াছেন অনেকেই। 

অনেকের ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে, যাহারা করোনার পূর্বে ব্যবসা শুরু করিয়াছিলেন তাহাদের অনেকে মূলধন খোয়াইয়া পথে বসিয়াছেন। ইহার পাশাপাশি করোনার অভিঘাতে যাহারা নূতন করিয়া দারিদ্র্যের খাতায় নাম লিখাইয়াছেন তাহারাও অনেকে হতাশা এবং বিষণ্ণতায় আত্মহত্যা করিয়াছেন। বিশ্ব জুড়িয়া অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হইবার আশঙ্কা, জ্বালানি-তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়া যাওয়া, পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের অক্ষমতা, পারিবারিক সহিংসতা ইত্যাদি বিষয় জটিল সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করিতেছে, যাহার প্রভাবে অনেকে আত্মহত্যামুখী হইতেছেন।

অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় মহামারিকালীন মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়া গেলেও মনে রাখিতে হইবে, আত্মহত্যা কখনোই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নহে। জীবনে ঘাত প্রতিঘাত, হতাশা, বিষণ্ণতা এবং চাপ থাকিবেই, এই সকল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মোকাবিলা করিয়াই সামনে আগাইয়া যাইতে হইবে। ইহার পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবার, সহপাঠী, নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে হইবে, পারিবারিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক বজায় রাখিবার ক্ষেত্রে হইতে হইবে আরো যত্নশীল। কেউ হতাশা কিংবা বিষণ্ণতায় ভুগিলে তাহার সার্বক্ষণিক তদারকি করিতে হইবে, প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা  করিতে হইবে। তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইত্তেফাক/এএইচপি