শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নূতন ইতিহাস তৈরি করিতে হইবে

আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২১, ১৩:২৫

ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার রবিবার লঞ্চে ৩৫ শতাংশ এবং বাসে ২৭ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করিয়াছে। ইহার পূর্বে গত রবিবার বাস ও লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্তের পর মালিক সমিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা ধর্মঘট তুলিয়া নেয়। কিন্তু ইহার পর হইতেই হিড়িক শুরু হয় বাড়তি ভাড়া নেওয়ার। ডিজেল, পেট্রোলের গাড়িসহ গ্যাসচালিত বাস হইতেও বর্ধিত ভাড়া নেওয়া হইতেছে। ইহা লইয়া গত দুই দিন রাজধানীতে সৃষ্টি হইয়াছে নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির। বিভিন্ন সড়কে চলিতেছে ভাড়া-নৈরাজ্য। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করিয়া বাড়তি ভাড়া আদায় করিতেছেন পরিবহন শ্রমিকরা।

এই যে পরিবহন মালিকরা ইচ্ছা হইলেই হুট করিয়া গণপরিবহন বন্ধ করিয়া দেন, ইহা তাহারা কী করিয়া করিতে পারেন? রাষ্ট্রের সহিত তাহাদের চুক্তি কী? তাহারা তো রাস্তায় চলিতেছেন রাষ্ট্রের অনুমতি লইয়াই। পরিবহন মালিকদের বা শ্রমিকদের সংগঠন তো নিবন্ধিত সংগঠন। নিবন্ধনের শর্ত কী? এইভাবে বিনা ঘোষণায় ধর্মঘট কি ডাকা যায় কিংবা পরিবহন চলাচল বন্ধ করা যায়? প্রশ্ন হইল, জনগণকে জিম্মি করিয়া যাহারা হঠাৎ ধর্মঘটের ডাক দিলেন, সরকার তাহাদের নিকট এত সহজে নতিস্বীকার করিল কেন? করোনার ভয়াবহ বিস্তার রোধে সরকার যখন দেশে বিভিন্ন দফায় অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করিয়াছিল, দিনের পর দিন বন্ধ করিয়া দিয়াছিল সকল পরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; সীমিত হইয়া গিয়াছিল অফিস-আদালতের কাজ, তখনো তো বিপুল অর্থনীতির ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও সরকার কঠোর অবস্থানে যাইতে বাধ্য হইয়াছিল। সাধারণ মানুষও তাহা মানিয়া লইয়াছিল, যেহেতু উহা ছিল একটি জীবাণুর বিরুদ্ধে জীবনমরণ ব্যাপার। সুতরাং সরকার তো চাহিলে এইবারও কঠোর ভূমিকা লইতে পারিত। বাস ও লঞ্চ মালিকরা হঠাৎ ধর্মঘট ডাকিয়া কতদিন বন্ধ রাখিতে পারে—তাহা দেখা যাইত।

জনগণকে জিম্মি করিয়া কোনো সভ্য দেশে কোনো গোষ্ঠী বা শক্তি সেই দেশটিকে স্তব্ধ করিয়া দিতে পারে না। সুতরাং সরকারও পালটা সকল কিছু বন্ধ করিয়া ইতিহাস সৃষ্টি করিতে পারিত। যেমনটি করিয়াছিলেন ব্রিটেনের লৌহমানবী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। ব্রিটেনে ১৯৮৪ সালে ন্যাশনাল কোল বোর্ড ২০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত করিয়াছিল। প্রতিবাদে শ্রমিকসংগঠন ধর্মঘট ডাকিল। তাহার আগেই থ্যাচার ইউনিয়নের আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন করিয়াছিলেন। তাহার ফলে ঐ ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয়। থ্যাচার ধর্মঘটীদের সহিত দেখা করিতেও অস্বীকার করেন। ফকল্যান্ড যুদ্ধে তাহার জয়ের তুলনা টানিয়া বলিয়াছিলেন—‘বাহিরের শত্রুদের মোকাবিলা করিয়াছি, ঘরের শত্রুদেরও করিব।’  প্রায় এক বত্সর পর কোনো দাবি আদায় না করিয়াই ইউনিয়ন ধর্মঘট প্রত্যাহার করিতে বাধ্য হইল। ব্রিটেন হইতেও জিম্মিকারী ইউনিয়নের চিরবিদায় ঘটিল।

অন্যায্য দাবি আদায় করিতে ধর্মঘট ডাকিবার খেসারত কীভাবে দিতে হয়, তাহার উদাহরণ আমাদের দেশেও একটি অন্তত আছে। আশির দশকে প্রেসিডেন্ট সাত্তার ধর্মঘটীদের উচিত শিক্ষা দিয়াছিলেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বিচারপতি সাত্তারের জামানায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মচারীরা ধর্মঘট করিয়াছিলেন। সরকারের অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও সিবিএর নেতাদের আস্ফালন ও ধর্মঘট একসঙ্গে চলিল। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ তাহাদের নিকট কোনো বিবেচ্য বিষয় নহে। রাষ্ট্রপতি সাত্তার এক দিন সময় বাঁধিয়া দিলেন—‘আগামীকাল সকাল ৯টার মধ্যে যাহারা কাজে যোগ দিবেন না, তাহাদের চাকরিচ্যুত করা হইবে।’ বেশির ভাগ নেতা ও ব্যাংক কর্মচারী মনে করিলেন, আলটিমেটাম দিয়াছে তো কী হইয়াছে? কিন্তু সাত্তার সাহেবকে সিবিএর নেতা ও ব্যাংক কর্মচারীরা চিনিতেন না। নির্দিষ্ট দিন সাড়ে ৯টায় ব্যাংকে তালা লাগাইয়া দেওয়া হয়। তাহার পর খুবই মর্মান্তিক পরিণতি হইয়াছিল আস্ফালনকারীদের। এখন সরকার যদি জনগণকে জিম্মিদশা হইতে মুক্ত করিতে না পারে, তখন জনগণ কী করিবে?

প্রদীপ নিভিবার পূর্বে তাহা নাকি জ্বলিয়া উঠে! যাহাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়া গিয়াছে, যাহারা নিভিয়া যাইতেছেন, তাহারা জ্বলিয়া উঠিলে তাহাদের কি চিরকাল এইভাবে জিম্মি করা যাইবে? মনে রাখিতে হইবে, একবার ইতিহাস তৈরি হইয়া গেলে জনগণকে জিম্মি করিবার সকল দুঃসাহস ও জারিজুরি শেষ হইয়া যায়, যেমনটি ব্রিটেনে হইয়াছিল আশির দশকে।

ইত্তেফাক/এমআর