শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও কিশোরদের অসতর্কতা

আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২১, ০৭:০০

সড়কপথে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে সম্প্রতি মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাইয়াছে। বর্তমানে ৪৯ লক্ষ নিবন্ধিত যানবাহনের প্রায় ৭০ শতাংশই মোটরসাইকেল। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই নহে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও দূরদূরান্তে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হইতেছে মোটরসাইকেল। যানজট, কম মূল্যসহ বিভিন্ন কারণে ইহার চাহিদা ক্রমবর্ধমান। তাহা ছাড়া দেশেও এখন এই যানবাহনটি তৈরি হওয়ায় বর্তমানে ইহা সুলভ এবং কিস্তিতেও ক্রয় করিতে পাওয়া যায়। জাতীয় অর্থনীতির জন্য এই বিষয়টি শুভ হইলেও উদ্বেগের বিষয় হইল, মোট সড়ক দুর্ঘটনার শিকার যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যাই সর্বাধিক। আবার মোটরসাইকেল-চালক ও আরোহীদের মধ্যে উঠতি বয়সের কিশোররাই অধিক দুর্ঘটনার কবলে পড়িতেছে, যাহা আরো গভীর চিন্তার বিষয়। যেমন—গত ৮ নভেম্বর টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে নবম শ্রেণির তিন ছাত্র মোটরসাইকেলে আনন্দ ভ্রমণে বাহির হইয়া দুর্ঘটনায় নিহত হয়। গত ১২ নভেম্বর একই জেলার ভূঞাপুরে আরো তিন কিশোর প্রাণ হারায় নূতন কেনা মোটরসাইকেলে ভ্রমণে বাহির হইয়া। যাত্রীকল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৭৯ শতাংশের বয়স ছিল ২১ বত্সরের কম। এইভাবে যদি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আমাদের নূতন প্রজন্মের ছেলেরা প্রাণ হারাইতে থাকে, তাহা হইলে আমাদের শ্রমশক্তিতে তাহার নেতিবাচক প্রভাব পড়িবে। কেননা তরুণরাই হইতেছে উত্পাদনক্ষম জনশক্তির বড় অংশ, যাহাদের উপর নির্ভর করিতেছে আমাদের আগামী দিনের উন্নয়ন ও অগ্রগতি।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ গুণ অধিক। অথচ একটি মোটরসাইকেল পাইতে একশ্রেণির কিশোর পাগলপারা হইয়া উঠে। তাহারা বাবা-মায়ের নিকট বায়না ধরে এবং মোটরসাইকেল ক্রয় করিয়া না দিলে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ছাড়িয়া দেয়। তাহারা মনে করে, মোটরসাইকেল চালাইতে পারাটা ছেলেদের জন্য অহংকারের বিষয়। ইহাকে তাহারা বীরত্বের প্রতীক মনে করে, যাহা মোটেও সঠিক নহে। সামাজিক মাধ্যমসহ নানা অপপ্রচারের কারণে তাহাদের মধ্যে বাইক রেসিংয়ের প্রবণতাও বাড়িতেছে, যাহা আরো মারাত্মক। উচ্চ শব্দ করিয়া কে কত দ্রুত গতিতে ও বিভিন্ন ভঙ্গিতে মোটরসাইকেল চালাইতে পারে, তাহার প্রতিযোগিতা চলে। তাহারা কখনো হেলিয়া-দুলিয়া ও স্ট্যান্ট করিয়া মোটরসাইকেল চালায়, যাহা বিপজ্জনক। তাহাদের এই মরণ খেলায় অনেকে বিরক্ত হইলেও, চাপা পড়িয়া অনেক প্রাণী ও মানুষ মারা গেলেও, এমনকি তাহারা নিজেরা হতাহত হইলেও ইহা হইতে অন্য কিশোররা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করিতেছে না। এই সকল কিশোর-তরুণদের লইয়া কোনো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মোটরসাইকেলের মহড়া প্রদর্শন করা হয়। তাহাদের দৌরাত্ম্যের নিকট স্থানীয় অধিবাসী এমনকি জনপ্রতিনিধি ও ট্রাফিক পুলিশরা অসহায় বোধ করেন।

কিশোরদের বাইক রেসিং এবং মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ করিতে হইলে পূর্বে বাবা-মাকে সচেতন হইতে হইবে। মোটরসাইকেল চালকদের হইতে হইবে প্রাপ্তবয়স্ক। তাহাদের থাকিতে হইবে ড্রাইভিং লাইসেন্স। মানিয়া চলিতে হইবে ট্রাফিক আইন। চালক ও আরোহীদের হেলমেট পরিধান করাও আবশ্যক। এই সকল নিয়মকানুন না মানিলে কাহাকেও মোটরসাইকেল চালাইতে দেওয়া যায় না। ইহা ছাড়া শুধু মোটরসাইকেল কেন, কোনো যানবাহনই বেপরোয়াভাবে চালানো উচিত নহে। কিশোরদের মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ করিতে মাঝেমধ্যে শহর ও গ্রামে অভিযান পরিচালনা করিতে হইবে এবং অবৈধ ও বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালকদের বিরুদ্ধে মামলাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা লইতে হইবে। সচেতন করিতে হইবে তাহার অভিভাবকদের।

বুয়েটের সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্যমতে, এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শীর্ষে অবস্থান করিতেছে বাংলাদেশ। যেহেতু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশ ঘটে মফস্সল এলাকায়, তাই সেখানে ট্রাফিক তদারকি বৃদ্ধি করা দরকার। নিয়ন্ত্রণ করা দরকার মোটরসাইকেলের সিসি। কিশোর-তরুণ মোটরসাইকেল চালকদের বিভিন্ন বাইকার্স গ্রুপ রহিয়াছে। সেখানেও তদারকি বাড়ানো যাইতে পারে। মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সতর্ক করাও বাঞ্ছনীয়।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি