বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কমলা হ্যারিসের ৮৫ মিনিট: নারী রাষ্ট্রপ্রধানের দিকে কতদূর এগোলো যুক্তরাষ্ট্র 

আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১৫:৪০

যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের জন্য রাজনীতির মাইলফলক সৃষ্টি হয় দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই। ১৯১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান পেয়েছেন নারীরা। প্রথম নারী কংগ্রেস সদস্য জিনেট র‌্যাংকিন থেকে বর্তমান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস পর্যন্ত  সবাই নিজেদের যোগ্যতায় জায়গা করে নিয়েছেন মার্কিন রাজনীতিতে। এদিকে, গত শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) ৮৫ মিনিটের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। দেশটির ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট পদে কোনো নারীর দায়িত্ব পালনের ঘটনা এটিই প্রথম। এরপরই আন্তর্জাতি রাজনীতি বিশ্লেষকদের মনে প্রশ্ন উঠেছে,  নারী রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের  দিকে কতটুকু এগিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 

১৮৬২ দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের ভোটাধিকারের দাবি ওঠে। এতে নেতৃত্ব দেন এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন ও সুজান বি অ্যান্টনি। এর পরপরই নারীরা ভোটাধিকার পান ১৯২০ সালে।

১৯১৬ সালে জিনেট র‌্যাংকিন প্রথম নারী হিসেবে কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হন। একজন সমাজ সংস্কারক, নারীকর্মী ও শান্তিরক্ষী। মন্টানা অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি এই নারী জয়ের পর বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো কংগ্রেসের প্রথম নারী সদস্য। তবে আমিই শেষ হবো না।’ তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। পরে  দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশের বিরুদ্ধে ভোট দেন। তিনিই কংগ্রেসের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি উভয় যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভোট দেন। 

১৯৩৩ সাল। ফ্রান্সিস পারকিন্স প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডিলানো রুজভেল্টের ক্যাবিনেটে শ্রম বিষয়ক মন্ত্রী হলেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনিই ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রথম  নারী। নিউ ডিল আইন প্রণয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারিগর ছিলেন পারকিন্স। এর মধ্যে ছিল ন্যূনতম মজুরির আইনও।

১৯৪০-১৯৭৩ সালে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে প্রতিনিধিত্ব করা প্রথম নারী রিপাবলিকান রাজনীতিক মার্গারেট চেজ স্মিথ।  চরিত্র নিয়ে সিনেটর জো ম্যাকার্থির আক্রমণের বিরুদ্ধে ‘ডিক্লারেশন অব কনসায়েন্স’ (বিবেকের ঘোষণা) হিসেবে সুপিরিচিত ভাষণের জন্য বিখ্যাত তিনি।

আমেরিকান বিপ্লবের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিনগুলো যে খুব ভালো কেটেছিল, তা বলা যাবে না। অঞ্চলভেদে নানারকম সমস্যা লেগেই থাকতো নবগঠিত দেশটিতে। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মূল মাথাব্যথা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা। ১৯৬৫ সালে ডায়ান ন্যাশ আরও কয়েকজনকে নিয়ে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের ছাত্র শাখার কার্যক্রম শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে ভোটাধিকারের জন্য প্রচার চালাতে থাকেন তিনি। অহিংস কৌশল অবলম্বন করে ডায়ান ন্যাশ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ নারী ও পুরুষদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করান। এভাবে ১৯৬৫ সালের ভোটাধিকার আইন পাসে অবদান রাখেন তিনি।

এরপর ১৯৭২ সালে শার্লি চিসম প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে বড় কোনো দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সম্পদ হচ্ছে আমার মুখ যাকে পেশাদার রাজনীতিকরা ভয় পান। এখান থেকেই নির্গত হয় এমন সব জিনিস যা রাজনৈতিক সুবিধার কারণে কারও সবসময় আলোচনা করা উচিত নয়।’

১৯৮৪ সালে জেরালডিন ফেরারো প্রথম নারী হিসেবে কোনো বড় দলের হয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পান। স্যান ফ্রান্সিসকোতে ডেমোক্রেটিক দলের সেবারের জাতীয় কনভেনশনে বলেছিলেন ফেরারো, ‘আমরা যদি এটা করতে পারি তাহলে যেকোনো কিছুই করতে পারবো।’

কন্ডোলিজা রাইস ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হন।   ২০০৫-২০০৯ পর্যন্ত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি।

২০০৮ সালে রিপাবলিকান দলের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেন সারা পেলিন।  রিপাবলিকান প্রার্থী সারা পেলিন ওই সময় ছিলেন আলাস্কার গভর্নর। তখন মা হিসেবে পরিবারে তার দায়িত্ব নিয়ে শ্যেন দৃষ্টি রেখেছিল। ব্যাপক কাটাছেঁড়া করেছিল সংবাদ মাধ্যম ও কিছু ডেমোক্রাট সদস্য। ওই সময় মিসেস পেলিনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে এক শিশু সন্তানের ডাউন সিনড্রম নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। জিনগত সমস্যা নিয়ে জন্মানো তার শিশু সন্তানকে অবহেলা করে তিনি রাজনীতিতে নামছেন কি না, তা নিয়ে সমালোচকরা বিস্তর প্রশ্ন তুলেছিলেন। 

২০১৬ সালে আরও এগিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের নারী ক্ষমতায়নের পথ। হিলারি ক্লিনটন প্রথম নারী হিসেবে বড় কোনো দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়লেন। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রের কাছে হেরে যান। তবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে অনেক কম বয়সী মেয়ে ও নারীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এর আগে হিলারি আইনজীবী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ছিলেন আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের ফার্স্ট লেডি, যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্টলেডি, নিউ ইয়র্কের সিনেটর ও দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

২০১৭ সালে সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের মার্কিন গভর্নর নির্বাচিত হন ৩৮ বছর বয়সী নিকি হ্যালি। পরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প  জাতিসংঘে দেশটির রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন তাকে। এর মধ্য দিয়ে প্রথম কোনো ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান  ক্যাবিনেট পর্যায়ের পদে অধিষ্ঠিত হন।

সর্বশেষ ২০২০ সালের নির্বাচনে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর কমলা হ্যারিসকে ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বেছে নেন। এই বছরের ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নিয়েছেন। হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট। এছাড়া প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ও প্রথম আফ্রিকান–আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি। 

নারীদের ভোটাধিকারের দাবি থেকে শুরু করে, কংগ্রেস সদস্য, মন্ত্রী, কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব, কৃষ্ণাঙ্গ নারী ও পুরুষদের ভোটাধিকার আইন পাস, কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াই, মার্কিন গভর্নর; সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের অধিকারীও নারী। বিশ শতক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মার্কিন রাজনীতিতে নারী ক্ষমতায়নের এই অগ্রগতিও বা গ্রাফ বলে দিচ্ছে নারী ক্ষমতায়নের দিকে অনেকাংশেই এগিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ইত্তেফাক/এনই