বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘আমি উত্তম হইব না কেন’

আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২১, ০৭:০০

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাহার কপালকুণ্ডলার উপকূলে সর্গে লিখিয়াছেন যে, উপকূলে আশ্রয় লওয়া সকল নৌকাযাত্রীর হিতার্থে নায়ক নবকুমার কাঠ আনিতে গিয়াছিল। এই দিকে জোয়ার চলিয়া আসায় দ্রুত নৌকা ছাড়িতে হইবে বিধায় সকলেই উদগ্রীব হইয়া গেল কখন নবকুমার আসিবে; কিন্তু নবকুমার সহসা আসে না। তখন বাকি সকলে মিলিয়া নিজেদের প্রবোধ দিল ‘নবকুমারকে ব্যাঘ্রে হত্যা করিয়াছে। তাহাই সম্ভব। তবে এত ক্লেশ-স্বীকার কী জন্য?’ তাহারা নবকুমারকে সেইখানে একাকী রাখিয়াই নৌকা লইয়া চলিয়া গেল। আর কাহিনী হইতে আমরা পাইলাম সেই বিখ্যাত উক্তি—তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ 

ইহার উপর ভর করিয়া আমরা আরেক ধাপ আগাইয়া বলিতে পারি—তুমি অধম কিংবা উত্তম যাহাই হও না কেন, আমি সবসময়ই উত্তম হইব। অর্থাৎ প্রত্যেকের স্ব স্ব ক্ষেত্রে উত্তম হইলে জগতের অর্ধেক সমস্যা ঠিক হইয়া যায়। আর এই উত্তম হইবার দৌড়ে সবচাইতে আগাইয়া রহিয়াছে তরুণেরা। সবুজের অভিযানে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলিয়াছেন—‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,/ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,/আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’, তেমনি নবীন আর তরুণরাই এখনো আমাদের হতাশার সলতেতে আশার আলো জ্বালিয়ে দেয়। সপ্তাহখানেক পূর্বে ইংল্যান্ডে ৮২ বত্সর বয়সি ব্রিটিশ নারীকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিয়া ২০ বত্সর বয়সীয় এক ব্রিটিশ মুসলিম তরুণ মারা গিয়াছেন। তিনি মারা গিয়াছেন বটে, তবে তাহার বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সকলের নিকট প্রশংসিত হইয়াছেন তিনি। সোমালিয়া বংশোদ্ভূত ২০ বত্সর বয়সি আলি যুক্তরাজ্যের কিংস্টন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি তিনি চিসউইক গেটরস বাস্কেটবল ক্লাবের ছেলে দলের প্রশিক্ষকও ছিলেন। তাহার শেষ কোচিং সেশনের কয়েক ঘণ্টা পর ঘটনাটি ঘটে। এইদিকে বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জে বখাটেদের কবল হইতে এক দম্পতিকে রক্ষা করিতে গিয়া ছুরিকাঘাতে সানজিদ দেওয়ান নামে এক তরুণ নিহত হইয়াছেন। নিহতের বন্ধু ও প্রত্যক্ষদর্শীরা সংবাদমাধ্যমকে জানাইয়াছেন, ব্যাডমিন্টন খেলিবার জন্য তাহারা কিল্লার পাশে কোর্ট কাটিতেছিলেন। রাতে সানজিদ ও তাহার বন্ধু সিজানসহ কয়েক জন বাঁশ আনিতে কিল্লারপুল যাইতেছিলেন। পথে তাহারা দেখিতে পান রিকশারোহী এক দম্পতিকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে কয়েক বখাটে। সানজিদ রিকশা ঘিরিয়া রাখিবার কারণ জানিতে গিয়া দেখেন সেইখানে স্থানীয় বখাটে ও ছিনতাইকারী এবং মাদকসেবীরা ঝামেলা করিতেছে। সানজিদ রিকশারোহীদের পক্ষাবলম্বন করিয়া তাহাদের ছাড়িয়া দিতে বলিলে বখাটেরা তাহাকে সেইখান হইতে চলিয়া যাইতে বলে। সানজিদ ইহার প্রতিবাদ করিলে তাহাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। এক পর্যায়ে দুই বখাটে সানজিদ ও তাহার বন্ধু সিজানকে ছুরিকাঘাত করিয়া পালাইয়া যায়। সানজিদের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাহাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হইলে কর্তব্যরত চিকিত্সক তাহাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

আমাদের বিপথগামী তরুণদের বিরুদ্ধে অকুতোভয় তরুণরাই আগাইয়া আসিতেছে। ইহা ভালো বটে, তবে এই ধরনের মৃত্যু কিছুতেই মানিয়া লওয়া যায় না। স্থানীয়রা জানাইয়াছেন, যাহারা ছুরিকাঘাত করিয়াছে তাহারা কিল্লারপুল এলাকার চিহ্নিত অপরাধী। সেইখানে তাহাদের মাদকের কারবারের কথাও গণমাধ্যমে আসিয়াছে। বখাটেরা একের পর এক অপরাধ করিয়া প্রকাশ্যে ঘোরাফিরা করিবে আর প্রতিবাদী উত্তম তরুণদের প্রাণ যাইবে—এহেন অবস্থা চলিতে পারে না। নিশ্চয়ই বখাটেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নিঃশেষে প্রাণ দান করিবার জন্য সানজিদদের মতো তরুণদের আমরা ভুলিব না; কিন্তু উত্তম প্রাণের এইভাবে খুন হওয়া মানিয়া লওয়া যায় না। এইরূপ ঘটনার পরও অনেক উত্তম তরুণ নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে নিজের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করিয়া অপরের হিতার্থে নবকুমার/সানজিদের মতো আগাইয়া আসিবে। তাহারা নিশ্চয়ই ভাবিবে—যে কোনো কিছুর ঊর্ধ্বে ‘আমি উত্তম হইব না কেন?’ কিন্তু আমরা চাই না কোনো প্রাণবন্ত তরুণ প্রাণ হারাউক। সুতরাং দেশের যে কোনো প্রান্তে বখাটে এবং মাদকসেবী ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি