শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে কুমিল্লার পুরাতন গোমতী

আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ০৬:৫৮

কুমিল্লার পুরাতন বা মরা গোমতী নদী দখল আর দূষণযজ্ঞে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ আঁকাবাঁকা এ নদীর দুই পাশের অংশ ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয়েছে দখল করে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনসহ নানা স্থাপনা। এছাড়া মানববর্জ্য, কচুরিপানা, বাসিন্দাদের বাড়িঘরের ও নগরীর ড্রেনের দূষিত ময়লা-আবর্জনা মিশে নদীর পানি বিষাক্ত করে তুলছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছেন মরা নদীর দুই পাড়ের অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। সরজমিনে ঘুরে প্রশাসনসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, একসময় কুমিল্লা শহর ঘেঁষে প্রবাহিত গোমতী নদীর পানি বর্ষাকালে বৃদ্ধি পেলে বাঁধ ভেঙে শহর তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শহরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়াত। তাই শহর রক্ষার জন্য গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এ নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। এরপর থেকে শহরের উত্তর প্রান্তের কাপ্তানবাজার হতে পূর্ব প্রান্তের শুভপুর-টিক্কারচর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার নদীর অংশ পুরাতন গোমতী নদী বা মরা নদী নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন থেকে স্থানীয়রা সুযোগমতো পুরাতন গোমতী নদীর টিক্কারচর, শুভপুর, সুজানগর, গাংচর, মোগলটুলী, পুরাতন চৌধুরীপাড়া, চাঁনপুর, গয়ামবাগিচা, কাপ্তানবাজারসহ বিভিন্ন স্থানের দুই পাড় ও পানির অংশ ধীরে ধীরে অবৈধভাবে দখলে নিয়ে নির্মাণ করে বহুতল ভবন, আধাপাকা বাড়িঘর ও দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। এতে পুরাতন গোমতীর দুই পাড়ে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে এবং আঁকাবাঁকা বিস্তীর্ণ নদী দখলযজ্ঞে সরু খালের আকার ধারণ করছে।

নদীর শুভপুরের আবদুল আউয়াল, গাংচরের আবদুল মবিন, কাপ্তানবাজারের মির্জা দবির উদ্দিনসহ নানা পেশার অন্তত ১৬ জন বাসিন্দা জানান, ‘এই নদীর পানিতে মরা গরু, হাঁস-মুরগি, কুকুর-বিড়াল, পশু-পাখি ছাড়াও কচুরিপানা, আবর্জনা ও ফেনসিডিলসহ নেশাজাতীয় মাদকদ্রব্যের বোতল ভাসতে দেখা যায়। এছাড়া শহরের ড্রেনের ময়লা পানি সরাসরি গড়িয়ে পড়ছে মরা নদীতে, যা থেকে উত্কট গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ নদী তীরে রয়েছে অসংখ্য ঝুলন্ত খোলা পায়খানা। নদীর কচুরিপানার ফাঁকফোকড়ে এই পানিতেই নিম্নবিত্ত ও ভাসমান পরিবারের শিশু-কিশোররা গোসল করে, সাঁতার কাটে, মহিলারা রান্নাবান্নায় ধোয়া-মোছার কাজ করে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছেন মরা নদীর দুই পাড়ের অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ।’

প্রবীণ সাংবাদিক রেজাউল করিম শামীম বলেন, ‘বর্তমানে দখল-দূষণে ধুঁকে ধুঁকে এ নদীর অস্তিত্ব অনেকটা বিলীনের পথে। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে এ মরা নদী কুমিল্লা নগরে পর্যটনের কেন্দ্র হতে পারে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই প্রাকৃতিক জলাধার প্রতিদিন প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে। নদীতে আবর্জনা ফেলে দখল করা হচ্ছে। এর অস্তিত্ব রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক আন্দোলনসহ সভা, সেমিনার জনসচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালন করেছি। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ও সিটি মেয়রকে স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।’

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘পুরাতন গোমতী নদী ঘিরে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার জন্য জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সিটি করপোরেশন সমন্বয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। এজন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদের পরামর্শ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।’

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, ‘পুরাতন গোমতী নদীর ভূমি যাদের দখলে আছে তাদের তালিকা হয়েছে। নদী দখলমুক্ত করতে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। এজন্য জনপ্রতিনিধিদেরও সম্পৃক্ত করা হবে। নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

ইত্তেফাক/বিএএফ