শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সুন্দরবনের হাতছানি...

আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ১১:৪০

সুন্দরের রানি সুন্দরবন ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলায়। বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবন দিনে চার বার তার রূপ বদলায়, যার সকালে এক রূপ, দুপুরে অন্যরূপ আর পড়ন্ত বিকালে নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়। আর রাতে গহিন অরণ্যের মধ্যে এক ভিন্ন শিহরন তৈরি করে সুন্দরবন। তাছাড়া অমাবস্যায় কিংবা চাঁদনি রাতে নানান রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয় সুন্দরবন।

চোখ জুড়ানো, শিহরন জাগানো অরণ্য সুন্দরবন। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ, গোলপাতার সুন্দরবন। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ বাংলাদেশের সুন্দরবন। সুন্দরবন বাংলাদেশের গর্ব, বাংলাদেশের রক্ষাকবচও। ঝড়ঝঞ্ঝা নিজের শরীর দিয়ে আটকে দিয়ে পুরো দেশকে রক্ষা করে এই সুন্দরবনই। প্রকৃতির ‘অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য’ কথাটা অবলীলায় শুধু এই বনকে নিয়েই বলা যায়। নদী, খাল ও সমুদ্র আর রহস্যঘেরা বনভূমি এই সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বনের মায়াবী রূপের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়ায়, শিহরন জাগায় প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে।

বনভূমি এই সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বনের মায়াবী রূপের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়ায়, শিহরন জাগায় প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে। মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে দীর্ঘ প্রায় দুই বছর সুন্দরবনে পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও পর্যটকদের জন্য ফের উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে বাঘ-হরিণের আবাসভূমি সুন্দরবন। আর এর পর থেকেই সুন্দরবনে আসতে শুরু করেছে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা।

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে সবসময়ই আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে। মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০২০ সালের ১৯ মার্চ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবন ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গত বছরের নভেম্বরে তা সাময়িক প্রত্যাহারের পর চলতি বছরের ৩ এপ্রিল আবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা বলবত্ ছিল ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। তবে করোনা মহামারি কমে গেলে গত পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে পর্যটকদের জন্য সুন্দরবনের পর্যটন স্পটগুলো খুলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে সুন্দরবনে আবারও পর্যটকদের আগমন শুরু হয়েছে।

সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ, এক থেকে দেড় লাখ চিত্রা হরিণ, ৪০ থেকে ৫০ হাজার বানর এবং ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার বন্যশূকর রয়েছে। যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে এক রোমাঞ্চকর বিষয়।

সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থল প্রাণী বাস করে। এছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, আট প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। বেঙ্গল টাইগার ছাড়া সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাল বানর, বনবিড়াল, সজারু, উদ এবং বন্যশূকর। প্রায় ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির, এদের সংখ্যা প্রায় ২০০। সাপের মধ্যে রাজ গোখরা, অজগর কেউটে এবং কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ উল্লেখযোগ্য।

সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনের ভেতরে ৯টি পর্যটন স্পট রয়েছে। প্রতি বছর সুন্দরবনে প্রায় ২ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করে থাকেন। তবে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রটি লোকালয়ের সবচেয়ে কাছের ও দর্শনীয় হওয়ায় এখানেই সাধারণ পর্যটকদের আনাগোনা বেশি। করমজল পর্যটন কেন্দ্রের ফুট টেইলার, সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার, লবণ পানির কুমির, মায়া ও চিত্রল হরিণ, বানর ও বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় পর্যটকরা। করমজল ছাড়াও পর্যটকদের কাছে সুন্দরবনের আকর্ষণীয় ভ্রমণ স্পটগুলো হচ্ছে— হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, হিরণ পয়েন্ট ও দুবলারচর। নভেম্বরের প্রথম দিন থেকেই এসব স্পটগুলোতে পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে।

সুন্দরবনের একটি পর্যটন কেন্দ্র।

প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর বৃহত্তম নিরবচ্ছিন্ন জোয়ারধৌত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত। ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পর বনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে, বাকিটা ভারতে। সমগ্র সুন্দরবনের প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে স্থিত; যার প্রায় ৬৯ শতাংশ স্থলভাগ ও বাকি ৩১ শতাংশ জলভাগ। জীব বৈচিত্র্যে সুন্দরবন অনন্য। নানা ধরনের গাছপালার চমৎকার সমারোহ ও বিন্যাস এবং বন্যপ্রাণীর অনন্য সমাবেশ এ বনভূমিকে চিহ্নিত করেছে এক অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে।

রূপান্তর ইকো ট্যুরিজম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আজম ডেভিড বলেন, করোনার কারণে দুই বছর লকডাউন থাকায় সুন্দরবনে কোনো পর্যটক প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে খুলনা অঞ্চলের শতাধিক ট্যুর অপারেটর কোম্পানি আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সুন্দরবনে পর্যটকরা আসতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, নভেম্বরের শুরু থেকে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। যা করোনার মধ্যেও খারাপ না।

নাজমুল আজম ডেভিড আরও বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু ট্যুর প্যাকেজের মূল্য বাড়েনি। ফলে ট্যুর অপারেটরদের লাভ তো দূরে থাক লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনের পর্যটন স্পটগুলোতে বর্তমানে দেশি পর্যটকের চাপ অনেক বেশি। কাছাকাছি ও কম খরচের কারণে এই সব পর্যটকরা করমজল, হারবাড়িয়া ও কলাগাছিয়াতেই বেশি আসছে। তবে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। শুধুমাত্র দূতাবাসে কর্মরত বিদেশিরা সুন্দরবন ভ্রমণে আসছেন।

তিনি বলেন, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, হয়ত সে কারণে বিদেশি পর্যটকেরা আসছে না।

খুলনা আঞ্চলিক বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, সেপ্টেম্বরে সুন্দরবন উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর যথেষ্ট পরিমাণে পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে আসছে। তবে এবার বিদেশি পর্যটক তুলনামূলক কম আসছে। করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে বিদেশি পর্যটকদের আসা-না আসার বিষয়টি।

খুলনা মহানগরীর অভিজাত ‘হোটেল ক্যাসল সালাম’ এর নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, আগে পর্যটন মৌসুম শুরু হলে বহু বিদেশি পর্যটক গ্রুপভিত্তিক সুন্দরবন ভ্রমণে আসত। বিশেষ করে জাপানি পর্যটকরা। তাদের বেশির ভাগই আমাদের হোটেলে উঠতেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে এখনো কোনো বিদেশি পর্যটকের দেখা মেলেনি। খুলনার অন্যান্য হোটেলের চিত্রও একই। মূলত হোলি আর্টিজানে হামলার পর থেকেই বিদেশি পর্যটক আসা তুলনামূলক কমেছে। তারপরও আমরা আশা করছি, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বিদেশি পর্যটকেরা সুন্দরবন ভ্রমণে আসতে পারে।

করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, গত ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ৫০০ পর্যটক করমজলে এসেছে। এর আগের নভেম্বরে ৪ হাজার ১৮৩ জন ও ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ৬ হাজার পর্যটক করমজল পর্যটন স্পটে এসেছিল। তিনি বলেন, এবার পর্যটকের সংখ্যা কম।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বর্তমানে সুন্দরবন দেখতে ভালোই পর্যটক আসছে। নভেম্বরের পর থেকে চাপও একটু বেড়েছে। করোনার আগে সুন্দরবনে যে সংখ্যক পর্যটক আসত এখনো সে রকম পর্যটক আসেনি। আশা করছি, ডিসেম্বর থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। তবে এ বছর দেশি পর্যটকের চেয়ে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। হয়ত করোনার কারণে বিদেশি পর্যটকরা কম আসছে না।

তিনি জানান, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই দুই মাসে পূর্ব সুন্দরবনে ৪ হাজার ৫৫৬ জন দেশি ও ৭২ জন বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেছেন। এখনো নভেম্বর মাসের হিসাব করা হয়নি। তবে আমরা আশা করছি, ডিসেম্বর থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে পারে।

ইত্তেফাক/এমআর