শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ঘণ্টাধ্বনি শুনিতে কি পাও?

আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২১, ০৯:১০

জগৎ সর্বদাই পরিবর্তনশীল। ইহা প্রকৃতির ব্যাপারেও যেমন সত্য, মানবসমাজ ও রাজনৈতিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেও সত্য। প্রায়শই প্রত্নতাত্ত্বিকরা মাটির গভীরে খনন করিয়া ৮ হাজার, ১০ হাজার বৎসর পূর্বের আস্ত শহর আবিষ্কার করিয়া থাকেন। 

এই আবিষ্কার হইতে আমরা যে চরম সত্যটি উপলব্ধি করি তাহা হইল, একসময় একটি জনপদ ছিল, তাহা শুধু বিলীনই হয় নাই, মাটির তলদেশে চলিয়া গিয়াছে। সুতরাং আমরা সকলেই অনুধাবন করি যে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। ঠিক একইভাবে মানবসমাজে একসময় পরিবার, সমাজ, গোষ্ঠী এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিয়াছে। 

বিবর্তনের মধ্য দিয়া সেই রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন আসিয়াছে, শাসনব্যবস্থায় আসিয়াছে পরিবর্তন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একসময় সামন্ত প্রথা, জমিদার প্রথা ছিল। তাহা কোনো দূর অতীত নহে। একসময় এই সামন্ত প্রথার বিরুদ্ধেই ফরাসি বিপ্লবের জন্ম হইয়াছিল, বাস্তিল দুর্গের পতন হইয়াছিল। কিন্তু তাহার পরও বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি কি মানুষের ক্ষোভ, অসন্তোষ দূর করিতে পারিয়াছে? বরং অতীতের সকল ধরনের নেতিবাচক কার্যকলাপ অতিক্রান্ত হইয়াছে।

ধনতন্ত্রের দুর্বলতাকে কাজে লাগাইয়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিবার প্রয়াস আমরা দেখিতে পাইয়াছি। সমাজতন্ত্র ধনতন্ত্রের মাঝামাঝি উদ্ভব হইল ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা। সমাজতন্ত্রের আশ্বাসও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। পূর্বে লেইসেসফেয়ার ও ধনতন্ত্রের প্রভাব থাকলেও ১৯৩০-এর দশকে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তখন বড় বড় অর্থনীতিবিদরা এই ধারণা পোষণ করেন যে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের একটি নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। কিন্তু অনেকেরই তাহা গ্রহণ করিতে কষ্ট হয়। পরে এই শর্তে তাহাদের ধারণা পালটায় যে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে, যদি রাষ্ট্র শতভাগ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করিতে পারে। 

কিন্তু বর্তমানে সকল ধরনের ব্যবস্থার ছাপাইয়া পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে চোরতন্ত্র। কথাটি শুনিতে খারাপ শুনা গেলেও ইহাই সত্য। পৃথিবীতে এমন কোনো শাসক খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না, যাহাদের মধ্যে লোভ ও চৌর্যবৃত্তির প্রবণতা নাই। প্রয়োজন হইলে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দেশ অন্য রাষ্ট্রের শাসককেও ধরিয়া লইয়া যায় প্রয়োজন ফুরাইয়া গেলে। বিশ্বব্যাপী আমরা সম্পদ লুটপাটের হিড়িক দেখিতে পাইতেছি। 

রাষ্ট্রীয় সম্পদ, জনগণের সম্পদ লুটিয়া একশ্রেণির বিভিন্ন ধনাঢ্য দেশে গড়িয়া তুলিতেছে বিলাসবহুল ভবন। আন্তর্জাতিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফুলিয়া উঠিতেছে। আবার সেই সংবাদও প্রকাশ করিতেছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশ। প্রশ্ন হইল যাহারা এই সকল সংবাদ প্রকাশ করিতেছে তাহাদের নিজেদের স্বচ্ছতা কি প্রশ্নে ঊর্ধ্বে? সুতরাং আমরা দেখিতে পাই, বিগত ১০০ বত্সরের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় লেইসেসফেয়ার, ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ওয়েলফেয়ার ইত্যাদি ছাপাইয়া চোরতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। 

কিন্তু যেহেতু পরিবর্তনই চিরাচরিত সত্য, তাই এই চোরতন্ত্রও একদিন পরিবর্তন হইয়া নূতন কোনো পরিস্থিতি মানুষ মোকাবিলা করিবে। যদিও উহা বিশ্বকে কোন পথে লইয়া যাইবে তাহা আমাদের জানা নাই। কিন্তু এইরূপ পরিস্থিতি তো চলিতে পারে না। এই চৌর্যবৃত্তির কালচারও একসময় ভাঙিবে। যাহারা চোর্যবৃত্তিকে অবলম্বন করিয়াছে তাহাদের মনে রাখিতে হইবে, এই দিনই দিন নহে। সামনে আরো দিন আছে। ইহাই পরিবর্তনের নিয়ম। 

কবি শুকান্ত ভট্টাচার্য বলিয়াছেন, ‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি, এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি, আমরা সকলেই যে যার প্রহরী উঠুক ডাক।’ তাই সকলকে এখন হইতেই সাবধান হইতে হইবে। শুনিতে হইবে আগামী দিনের ঘণ্টাধ্বনি। 

ইত্তেফাক/এএএম