রাজধানীতে ঝুকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বেড়েই চলছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তবে, তারা এ-ও বলছেন, এই শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সুনির্দিষ্ট তালিকা কখনোই তৈরি হয়নি৷ সরকারের একেক প্রতিষ্ঠান একেক রকম সংখ্যা জানিয়েছে৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সিটি করপোরেশনের তথ্যে বিস্তর অমিল। ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ।
২০১৬ সালের ০৭ জানুয়ারিতে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, ঢাকায় ৭২ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ২০০৪ সালে পুরান ঢাকায় ভবন ধসে ১৭ জনের মৃত্যুর পর অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের করা জরিপে রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পাঁচশর মতো ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। পরে ২০১৬ সালে তালিকাটি হালনাগাদ করা হয়। তাদের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। এরমধ্যে বিধিবিধান লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন রয়েছে ৫ হাজার। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি ভবনের বেশির ভাগই রয়েছে পুরান ঢাকায়। এর মধ্যে সূত্রাপুর থানা এলাকায় রয়েছে ১৪৬টি, কোতোয়ালিতে ১২৬টি ও লালবাগে ২৮টি। বাকি ২১টির মধ্যে মোহাম্মদপুরে ৬টি, ডেমরায় ৩টি, মিরপুরে ৭টি, রমনায় ১টি, তেজগাঁওয়ে ১টি, মতিঝিলে ২টি ও ধানমন্ডিতে ১টি।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির ২০১৯ জানুয়ারির বৈঠকে ত্রুটিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ ভবন দ্রুত অপসারণের উদ্যোগ নিতে সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশের আলোকে ৯০৬ ভবনকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে রাজউক।
তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী এ্যাড. শ ম রেজাউল করিম ২৫ জুন ২০১৯ সালে পরিবেশবান্ধব আবাসিক এলাকা তৈরি করতে রাজধানী ঢাকার অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পর্যায়ক্রমে ভেঙে ফেলা হবে বলে জানিয়েছিলেন । তখন ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে এক হাজার ৮১৮টি ভবন তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।
সমপ্রতি, রাজউক চেয়ারম্যান জানান, ঢাকার দুই সিটিতে সাড়ে ৩ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ভবন রয়েছে। এছাড়া, আরো ১ হাজার ভবন তদন্তাধীন রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
সম্প্রতি, রাজউক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ফায়ার সার্ভিস রাজধানীর প্রায় চার লাখ ভবনের ওপর জরিপ করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।
পুরনো ঢাকার সরু অলিগলির দুই পাশে গেলে দেখা যাবে, এখনো গায়ে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ভবন। সর্বোচ্চ তিন তলা গাঁথুনি যে ভবনটির, সেখানে নির্দ্বিধায় তোলা হচ্ছে ৫/৬ তলা। জগন্নাথ পাড়া এলাকায় ৩০০ থেকে ৪০০ বর্গফুট জায়গায় একটি ৫ তলা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এর বিভিন্ন তলায় বসবাস করছেন ১ পরিবারের অন্তত ১৫ জন সদস্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আক্তার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সবশেষ ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসাবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে। এছাড়া ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে ৭ কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পরিসংখ্যান ও অপসারণ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটিতে সাড়ে ৩ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ভবন রয়েছে। আরও ১ হাজার ভবন তদন্তাধীন রয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে সঙ্গে নিয়ে আমরা একটা প্রকল্প নিয়েছি। এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে তা একটা মডেল হবে। তবে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। আমরা দ্রুতই কাজ শুরু করতে চাই। আমাদের প্রথম কাজ হবে বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবনের পাশের রাস্তাগুলো বড় করা, সেটব্যাক ভেঙে ফেলা। ঐতিহ্যবাহী ভবন রক্ষা করা, যে ভবন রাখা যাবে না, তা ভেঙে দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে আমরা একটা প্রকল্প দাঁড় করিয়েছি। আমাদের ড্যাপের পিডিকে দিয়ে কাজ করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত কাজটি করতে পারবো।’
স্থাপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রাজউক যেভাবে সারা ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে নেমেছে, তা আসলে কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না৷ এতে বছরের পর বছর লেগে যাবে৷ কাজটি করা দরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে৷ যেমন মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্স, অফিস, বাণিজ্যিক কেন্দ্রর মতো ভবন, যেখানে লোক সমাগম বেশি হয় সেগুলো নিয়ে আগে কাজ করা দরকার৷ সেগুলোর ফায়ার সেফটি ও সিকিউরিটি নিয়ে আগে ভাবা উচিত৷ আগে জরুরি ভিত্তিতে জীবন রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে৷ রাজউক যেভাবে কাজ শুরু করেছে তাতে আমার মনে হয় তারা বিষয়টি অন্যদিকে নিয়ে যেতে চায়।’