বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘বড় ভাই’দের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি চলছেই

আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০৭:৪৮

চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে প্রথমে ভয়ভীতি দেখাতে ঐ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে প্রকাশ্যে ফাঁকা গুলি করা হয়। বেশির ভাগ সময় ভয়ে ঐ ব্যক্তি দাবিকৃত চাঁদা প্রদান করেন। রাজি না হলে প্রকাশ্যে গুলি চালাতে তারা পিছপা হয় না। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরকম অস্ত্রধারী চাঁদাবাজ গ্রুপের দৌরাত্ম্য চলছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ পেলেও পুলিশ বেশির ভাগ ঘটনা শনাক্ত করতে পারেনি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, এ ধরনের গুলির ঘটনার আশি ভাগই পুলিশ শনাক্ত করে গ্রেফতার করেছে। গুলি ছোড়া সন্ত্রাসীদের মুখে মাস্ক থাকার কারণে শনাক্ত করতে একটু সমস্যা হয়। কয়েক দিন আগে ডিবি দুইটি ঘটনা শনাক্ত করে চাঁদাবাজ চক্রকে গ্রেফতার করেছে। দুই একটি ঘটনা হয়তো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সেটাও শনাক্ত করার জন্য তদন্ত করছে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এসব চাঁদাবাজ গ্রুপের পেছনে বিদেশে আত্মগোপনকারী শীর্ষ সন্ত্রাসীরাই কলকাঠি নাড়ছে। স্থানীয় গ্রুপগুলো দিয়ে চাঁদাবাজির পর ঐ চাঁদার একটি বড় অংশ তাদের কাছে পৌঁছে যায়। চাঁদা দাবি করার সময় চাঁদাবাজ গ্রুপগুলো শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ‘বড় ভাই’ বলে সম্বোধন করে চাঁদা দাবি করে। গত ১০ বছরে রাজধানীতে চাঁদা দাবি করে ফাঁকা গুলির ঘটনা ঘটেছে অন্তত শতাধিক। ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে অথবা বাড়ির মালিকের কাছে চাঁদা দাবি করার ঘটনা ঘটেছে অহরহ। ২০১০ সালের দিকে পোশাক তৈরির একটি শীর্ষস্থানীয় গ্রুপের মালিকের কাছে ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে শীর্ষ সন্ত্রাসী শুব্রত বাইন গ্রুপ। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তার স্কুলগামী সন্তানকে বহন করা মাইক্রোবাস লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। এতে মাইক্রোবাসে থাকা ঐ ব্যক্তির এক নিকট আত্মীয় নিহত হয়। গত বছর করোনা ভাইরাসের লকডাউনের এক মাস আগে রাজধানীর পান্থপথে একটি ডেভেলপার কোম্পানির বহুতল ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। সন্ত্রাসীরা ঐ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে।

রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা, ভাটারা, উত্তরা, মিরপুর, কাফরুল ও পল্লবী এলাকায় অস্ত্রধারী চাঁদাবাজ গ্রুপগুলো এভাবে গুলি করে চাঁদা দাবি করছে। গত ১২ নভেম্বর বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টের ৪ নম্বর রোডের এসটিকে পাওয়ার জেনারেটর নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক শহীদুল ইসলাম টুটুলের কাছে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ফোন করে। বলে, ‘আমাদের টিম প্রত্যেকটা মুহূর্ত আপনাকে ফলো করতেছে। আর না হলে আপনাকে যেটা করার বা বলার তা সামনে এসেই বলব। সিঙ্গাপুরের বড় ভাইয়ের নির্দেশ কাল সকালে ৫ লাখ টাকা রেডি রাখবেন। না হলে বাঁচতে পারবেন না।’    

এমন ফোন পেয়ে ব্যবসায়ী টুটুল আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি চাঁদা দিবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। ফোন করার দুই দিন পর ১৪ নভেম্বর দুপুরে দুই জন যুবক তার প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। তাদের একজন বলে, তুই তো এখনো বুঝতে পারিসনি। তোকে বোঝার জন্য ফাঁকা গুলি করছি। নেক্সট টাকা না দিলে তোর বুকে গুলি ঢুকবে।’ এরপর তারা এক রাউন্ড গুলি করে হেঁটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম টুটল বলেন, ঐ ঘটনার দিন রাতেই আমি বাড্ডা থানায় মামলা করি। এরপর থেকে তারা মামলা করার কারণ দেখিয়ে আবারও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আমি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যবসা করে সংসার চালাই। ৫ লাখ টাকা চাঁদা আমি কোথায় থেকে দিব?’

গত বছরের ৫ আগস্ট বাড্ডার হোসেন মার্কেটের পিছনে ময়নারবাগে একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মোরসালিন বাবুর বাড়ি লক্ষ্য করে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। বিদেশে আত্মগোপন করা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আফতাবনগর পশুর হাটের চাঁদার ভাগবাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র  করে তার বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় মোরসালিন বাবু বাড্ডা থানায় জিডি করলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত ঐ চাঁদাবাজ গ্রুপকে শনাক্ত করতে পারেনি।

উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট নামে একটি বায়িং হাউজের মালিক আহমেদুর রহমান সম্রাটের কাছে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে এলাকার সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রধান জুয়েল। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে গত ২ ডিসেম্বর রাত ৯টার দিকে ঐ প্রতিষ্ঠানে রাজু, বাঁধন, রাশেদ ও সৌরভসহ ৮/৯ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী প্রবেশ করে আহমেদুর রহমান সম্রাটের ওপর হামলা চালায়। এসময় সন্ত্রাসীরা ফাঁক গুলি করতে চাইলে সম্রাট চিৎকার করেন। তখন সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। পরে ঐ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মামুন মোল্লা নামে এক কর্মকর্তা বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, বিদেশে আত্মগোপন করা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা গত ১০ বছর ধরে স্থানীয় ছোট ছোট চাঁদাবাজ গ্রুপগুলোকে দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছে। ভারতে আত্মগোপন করা নরোত্তম সাহা ওরফে আশিক, পল্লবী এলাকার মোক্তার এবং মিরপুর এলাকার শাহাদত ছোট ছোট গ্রুপ দিয়ে চাঁদাবাজি করে। আমেরিকায় আত্মগোপন করা শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী বাড্ডা ও ভাটারা এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। দুবাইয়ে আত্মগোপন করা জিসান আহমেদ মন্টি রামপুরা ও খিলগাঁও এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। মালয়েশিয়ায় আত্মগোপন করা ডালিম-রবিন গ্রুপ বাড্ডা, নিকেতন ও গুলশান এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, আমেরিকায় আত্মগোপন করা শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী ও দুবাই-মালয়েশিয়ায় আত্মগোপন করা জিসান-ডালিম-রবিন গ্রুপ এ ধরনের চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। বিদেশে অবস্থানকারী ঐ সব গ্রুপ দেশে অবস্থানকারী দুষ্ট গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করছে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় ছোট ছোট চাঁদাবাজ গ্রুপের যোগাযোগ হয়। এ ধরনের চাঁদাবাজ গ্রুপগুলোকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তারা যারাই হোক, আমরা তাদের গ্রেফতার করব।

ইত্তেফাক/এমআর