অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় একটি অসামান্য অর্জন। হাজার বছরের ইতিহাসে এর মধ্যে দিয়ে বাঙালি পেয়েছিল তার প্রথম স্বাধীন স্বদেশ আর প্রথম ভূমিপুত্র শাসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
এ জাতির ইতিহাসে কখনোই যেমন নিজেদের কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ইতিহাসের পাতায় অনুপস্হিত, তেমনি একইভাবে এ দেশকে ইংরেজ, আরব আর হাবসি অনেকেই শাসন করে গেলেও, বাঙালি বরাবরই তার নিজের শাসকের অধীনে শাসিত হবার সুযোগ বঞ্চিত থেকেছে। পাশাপাশি পৃথিবীর বুকে সম্ভবত একমাত্র এই জাতি রাষ্ট্রটির আবির্ভাব, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মূল কনসেপ্টটিকেই নাল অ্যান্ড ভয়েড করে দিয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে যে ধর্ম নয় বরং ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর অসাম্প্রদায়িকতার বন্ধনই একটি সফল রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। আর ঠিক এ কারণেই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যর্থ প্রমাণের সব আয়োজন চূড়ান্ত করে রাখার প্রয়াস পাকিস্তানের ছিল বরাবরই, এখনো আছে, থাকবে ভবিষ্যতেও।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের ঠিক আগে আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশটাকে মেধাশূন্য করে দেওয়া, যাতে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে দেশটা। মেধার সেই শূন্যতায় আজও ধুঁকছে বাংলাদেশ।
১৫ আগস্টের কালরাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের চূড়ান্ত অ্যাসল্ট। এর পর থেকে একের পর এক পাকিস্তানি ঘরানার শাসক জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ আর খালেদা জিয়ার শাসনে ক্রমাগতই পেছনে ছুটেছে বাংলাদেশের অনুন্নয়নের চাকা। ক্রমশই যখন মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত হওয়ার পথে ছুটছিল বাংলাদেশ, সেখান থেকে বাংলাদেশের আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে, ইউটার্ন করে সামনে ছুটে চলা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই।
তার জাদুর কাঠির ছোঁয়াতেই বাংলাদেশ আজ কি উন্নয়নেই হোক, কি কোভিড প্যান্ডেমিক মোকাবিলায়, কি জলবায়ু সংরক্ষণে তো কি এসডিজি অর্জনে—সব ক্ষেত্রেই আজ তাবত্ বিশ্বের রোল মডেল। এই এগিয়ে চলা বাংলাদেশটাকে থামিয়ে দেওয়ায় একের পর এক চক্রান্ত এখনো চলমান। গত বছরের নভেম্বরে অর্বাচীন মামুনুলের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার দম্ভোক্তির মধ্যে দিয়ে সেই যে শুরু, তার পর থেকে একের পর এক বন্ধুপ্রতিম ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ সফরের সময় সৃষ্ট অস্থিরতা আর নাশকতা, বিগত শারদীয় দুর্গোত্সবের সময়ে দেশ জুড়ে অশান্তির বাতায়ন প্রতিষ্ঠা, নভেম্বরে পাকিস্তানে পাক-বাংলা মৈত্রী সম্মেলন আয়োজন করে সেখানে বঙ্গবন্ধুর ‘গাদ্দার’ ছিলেন কি ছিলেন না তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা আর সবশেষ পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের অনুশীলনে ঢাকার মাঠে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন কিংবা ঢাকার গ্যালারিতে পাকিস্তান সমর্থক ‘বাংলাস্তানিদের’ নির্লজ্জ বেলাল্লাপনা—এসব কিছুই মোটা দাগে আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হলেও, এসব প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের সবচাইতে বড় দুটি উদযাপন, ‘মুজিব শতবর্ষ’ আর ‘বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীকে’ কলঙ্কিত করার জন্য পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের অংশ।
এত কিছুর পরও ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে চলেছে বাংলাদেশ। ছুটে চলেছে শেখ হাসিনার হাত ধরে, সব ষড়যন্ত্র আর কোভিডকে হার মানিয়ে, দুর্নিবার গতিতে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ করার এত যে পাকিস্তানি আয়োজন, সেই পাকিস্তানিরা আজ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে বাংলাদেশের একটি টাকা কিনতে এখন তাদের ব্যয় করতে হয় পাকিস্তানের দুই রূপিরও বেশি।
আজ যখন শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপ কোভিডে পর্যুদস্ত নিজেদের অর্থনীতিকে বেইল আউট করার জন্য বাংলাদেশের সহায়তা প্রত্যাশা করছে, ঠিক তখনই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, ডলারের বিরুদ্ধে রুপির দর পতনে স্থানীয় কর্মচারীদের বেতন দিতে অসমর্থ ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাস থেকে জরুরি অর্থ সাহায্য চাওয়া হয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। আগস্ট মাস থেকে বেতন বাকি পড়েছে দূতাবাসটির স্থানীয় কর্মচারীদের। একই সময় সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসও তিন মাস ধরে তাদের ডিপ্লোম্যাটদের সন্তানদের স্কুলের বেতন পরিশোধ করতে অসমর্থ হয়ে এসওএস বার্তা পাঠিয়েছে ইসলামাবাদে এমন তথ্যও এসেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়।
তবে সবচেয়ে যা লক্ষণীয় তা হলো, যে পাকিস্তানিরা একদিন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নির্বাচনে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত করায় অকাতরে টাকা দিয়েছে এই দলটিকে, যার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্হা আইএসআই-এর সাবেক প্রধান খোদ পাকিস্তানের আদালতে, সেই পাকিস্তানের ঢাকার হাই কমিশন এ দেশে অধ্যয়নরত তাদের ডিপ্লোমেটদের সন্তানদের স্কুলের বেতন দিতে না পেরে সাহায্য চেয়ে জরুরি বার্তা পাঠিয়েছে ইসলামাবাদে গত সেপ্টেম্বরের শেষে। এই ডিসেম্বরের ১৬-তে বিশ্ব যখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে বাংলাদেশের পঞ্চাশে ‘বঙ্গশক্তির’ উত্থান, তখন অন্যদিকে নিজেদের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীকে সামনে রেখে আত্মবিধ্বংসী পথপরিক্রমায় ক্রমেই ম্রিয়মাণ এক সময়ের পৃথিবীর চতুর্থ সামরিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র পাকিস্তান। বিজয়ের পঞ্চাশে এর চেয়ে বড় উদযাপনের উপলক্ষ্য আমার মাথায় এ মুহূর্ত অন্তত আর কিছু আসছে না।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ