বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভমহানি ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মটি ছিল এক বিস্ময়। তখনকার বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, পাকিস্তানের সুসংহত প্রতিরক্ষা ও শক্তিশালী কূটনীতি, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাকে কারাগারে আটক রাখা, বাঙালি নামধারী এদেশীয় কিছু কুলাঙ্গারের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্হান, দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপপ্রচারে এ দেশ স্বাধীন হবে তা ছিল চিন্তারও বাইরে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সাল থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান। স্বাধীনতার জন্য জাতিকে প্রস্ত্তত করেন।
পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ থেকে বিকাশ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও সর্বস্তরের মানুষের ত্যাগ ও সংগ্রাম এদেশকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। দেশিবিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এক সর্বাত্মক গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে শক্তিশালী পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসরদের পরাস্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। ৬ দফা দাবি, ১৯৭০-এর নির্বাচনি ইশতেহার, পরবর্তী সময় স্বাধীনতার ইশতেহার ও স্বাধীনতার ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে একটি শাসনতন্ত্র তৈরি ও কার্যকর করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে অসহযোগিতার চ্যালেঞ্জ নিয়েই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ক্যু পালটা ক্যু-এর মাধ্যমে দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলস্বরূপ সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সবক্ষেত্রে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ি।
১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক ও সামরিক ঘরানার সরকারগুলোর সামনে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুস্পষ্ট কোনো ভিশন ও মিশন ছিল না। এতে করে এদেশের সাধারণ জনগণ মুক্তিযুদ্ধের সুফল থেকে হয় বঞ্চিত। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার জাতির সামনে একটি রূপকল্প তুলে ধরে। আর এই রূপকল্পের হাত ধরেই বাংলাদেশ অদম্য গতিতে এগিয়ে চলছে। আর্থসামাজিকভাবে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকা আজ বিশ্বের কাছে বিস্ময়। এভাবে বাংলাদেশের স্বপ্নের দিগন্ত দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক উত্তরণ ঘটিয়ে এবং মাথাপিছু আয়ের নতুন নতুন রেকর্ড, অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন ও যুবসমাজকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশের কাতারে অবস্হান করার জন্য এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ ভালো করছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে দারিদ্রের হার ছিল ৮২ শতাংশ। ২০১৬ সালে দারিদ্রের হার দাঁড়ায় ২৪.৩ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে দারিদ্রের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্হা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল-২০২১’-এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ২০৩৫ সালে বিশ্বের ২৫টি বড় অর্থনীতির একটি দেশ হবে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যত্কেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হলে দেশের সব স্তরে অগ্রগতি আসবে। প্রবৃদ্ধির হার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশকেও ছড়িয়ে যাবে। কোভিডকালেও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩৩ সালে অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে অর্থনীতি সূচকসমূহ বলছে। বৈশ্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা এমডিজি অর্জনে যেমন বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে; তেমনি এসডিজিতেও বাংলাদেশ ভালো করছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ যেখানে বৈশ্বিক শান্তিতে ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ; বাংলাদেশ সেটা দমনে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সাফল্য বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার আসনে নিয়ে গেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ১০০ স্পেশাল ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা কমবে। বাড়বে রপ্তানি আয়।
বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখে বিস্মিত হওয়ার পাশাপাশি আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আমাদের অপার সম্ভাবনার যুবসমাজ যাদের ভূমিকা বাংলাদেশের অদম্য অগ্রগতির মূলে তাদের ধ্বংস করার দেশিবিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে। মাদক ও অপসংস্কৃতির প্রবেশ আমাদের যুবসমাজের সঠিক ব্যবহারে সবচেয়ে বড় বাধা। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মাঝে মাঝে আমাদের অর্জনকে ম্লান করে দেয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শুরু থেকে আজ অবধি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে নীতিহীনতা প্রবেশ করায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের সুফল আজও পুরোপুরি ভোগ করতে পারছি না। একটি শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করলেও সমাজে অর্থনৈতিক সমতা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের অন্যতম ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশ আজও পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন ও উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে না।
লেখক : অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ,শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট|