শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভাড়ায় খুনে নেমেছে কিশোর গ্যাং

আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:০০

পরনে টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস। নিত্য নতুন অভিনব হেয়ার স্টাইল। পাড়া, মহল্লা, অলিগলি ও ফুটপাতে জমিয়ে আড্ডা দেয় তারা। দামি লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে হিরোদের মত দেয় টান। উচ্চ স্বরে গান করে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ক্ষেত্রে বয়সের কোন বাছ-বিচার নেই। এলাকাভেদে এদের রয়েছে পৃথক গ্রুপ। 

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিশোর গ্যাংদের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। নিজেদের মধ্যে খুন খারাবির পর এখন পেশাদার কিলার গ্রুপের মত ভাড়ায় খুন করতে শুরু করেছে কিশোর গ্যাং গ্রুপ। গত ১২ ডিসেম্বর রাতে শাহাদাত হোসেন হাসিব নামে এক কিশোরকে ধারালো ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হৃদয় ও তার সহযোগীরা। এ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার হৃদয়কে ঝালকাঠি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও চারজনকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এ ব্যাপারে পুলিশের মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এ জেড এম তৈমুর রহমান বলেন, মিরপুরের ‘ডন’ হতে চেয়েছিল হৃদয় (১৭)। সেই স্বপ্ন পূরণে অপরাধে জড়ায় সে। প্রবাসীর জমি সংক্রান্ত বিরোধ মেটাতে দুই লাখ টাকার চুক্তিতে শাহাদাত হোসেন হাসিব নামে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, নিহত হাসিবের বাবার সঙ্গে প্রবাসী বিপুল নামে এক ব্যক্তির বাবার জমিসংক্রান্ত মামলা চলছিল নোয়াখালীতে। সেই মামলার জের ধরে হাসিবকে হত্যার পরিকল্পনা করে গ্রেফতারকৃত মোফাজ্জল হোসেন মণ্ডল। পরিকল্পনা অনুযায়ী হৃদয়ের সঙ্গে দুই লাখ টাকায় চুক্তি করে মোফাজ্জল। তবে হত্যাকাণ্ডের পর চুক্তি অনুযায়ী টাকা দেওয়া হয়নি হৃদয়কে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, বিপথগামী কিশোরেরা এলাকায় মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, চাঁদাবাজি এমনকি হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এই কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে শতাধিক গডফাদার। পর্দার আড়ালে থেকে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী এসব গডফাদার কিশোর গ্যাং দিয়ে এলাকায় মাস্তানি, চাঁদাবাজি ও এলাকা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের যে ধরনের অপরাধ করার নির্দেশ দিয়ে পাঠানো হয়, ঠিক সেরকম অপরাধই কিশোররা ঘটিয়ে থাকে। আবার বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে জমি সংক্রান্ত বা আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিলে পরিবারের পক্ষ নিয়ে অনেক কিশোর অপরাধমূলক কাজ করে থাকে। আবার বস্তি এলাকার  অনেক কিশোর অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াই এক একটি গ্রুপ তৈরি করে। অন্যকে শায়েস্তা করতে তারা মারামারি করে। এজন্য যেসব দেশে কিশোর অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়, সেসব দেশ কিশোর কারাগার চালু করে। আমাদের দেশেও কিশোরদের অপরাধ এতটাই বেড়ে গেছে যে এ ব্যাপারে কিশোর কারাগার চালু করা যায় কি না- তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। আদালতের মাধ্যমে কিশোরদের সংশোধনাগারে পাঠানোর পর তাদের অবস্থা কি দাঁড়ায়, সে বিষয়ে ফলোআপ করা হয় না। কিশোর সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর তার কেসস্টাডি ফলোআপ করতে হবে। সর্বোপরি সমাজভিত্তিক সমষ্ঠিগতভাবে কিশোরদের উন্নয়ন বা পরিবর্তন করতে হবে। 

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এই মুহূর্তে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেছে। র‍্যাব ব্যাটালিয়নগুলোতে এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশে দেওয়া হয়েছে। কিশোর গ্যাংদের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সমাজের অভিভাবক শ্রেণী, শিক্ষক শ্রেণী ও ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে র‍্যাব কিশোরদের সচেতন করার কাজ করছে। স্কুলগুলোতে র‍্যাবের পক্ষ থেকে সচেতনমূলক নির্দেশনা সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। আইনজীবী তুহিন হাওলাদার বলেন, এরা কিশোর বলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সের কেউ অপরাধ করলে তার বিচারকার্য সম্পাদন করা যাবে না, তাকে আটক করে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠাতে 

১৫ বছরে ১১৫ খুন: ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ১১৫ টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৫ সালের ২৭ মে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় মাইলস্টোন স্কুল এ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্র অনিককে (১৫)। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনান কবির। আদনান খুন হওয়ার পর উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৯ সালের ২৯ জুন হাজারীবাগ এলাকায় ১৫ বছর বয়সী ইয়াছিন আরাফাত ও একই বছরের ৭ জুলাই গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র শাওন খুন হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে কিশোর গ্যাং গ্রুপের দ্বন্দ্বে মহসিন নামে এক কিশোর খুন হয়। 

সমাজ বিজ্ঞানীরা যা বলেন : মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন বলেন, কিশোররা এখন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা এই বয়সে এমন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে বা ফলনা করে এবং সেখান থেকেই তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। কিশোরদের গ্যাং কালচার থেকে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এক সাথে কাজ করতে হবে।

ইত্তেফাক/এএইচপি